ঢাকা: বাংলাদেশে বিগত সময়ে এক ধরনের শিকারী সাংবাদিকতা উদ্ভব ঘটেছে। যার মাধ্যমে মুহূর্তেই কাউকে অপরাধী বানিয়ে শাস্তি দেওয়া যেত।
শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে মূলপ্রবন্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক আ-আল মামুন এ কথা তুলে ধরেন।
‘ফ্যাসিবাদের জমানায় শিকারী সাংবাদিকতা’ শিরোনামে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) সেমিনারটি আয়োজন করে।
সেমিনারে বক্তব্য দেন লেখক ও চিন্তক ড. সলিমুল্লাহ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ।
আ-আল মামুন বলেন, ‘ভারতীয় হাইকমিশন শুরুতে বাংলাদেশের অনেকগুলো গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। পরে ঢাকা শহরের মধ্য পর্যায়ের সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক গড়েছে। ২০১৮ সালের পর সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের তাদের ‘পে রোলের’ অধীনে নিয়ে এসেছে। তারা যে কাউকে শিকার করতে চাইলে এ সিস্টেম একসঙ্গে কাজ করেছে’।
বাংলাদেশে শিকারী সাংবাদিকতার উত্থানের কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ ও আমেরিকায় এ শিকারী সাংবাদিকতা দেখা যায়নি, বাংলাদেশে ঘটেছে। কারণ আমাদের সংবাদ ব্যবস্থায় প্রপাগান্ডা চালানোর সুযোগ আছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক একটা মব তৈরি করে কাউকে অপরাধী করা যায় না। শিকারী সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে মুহূর্তেই কাউকে (ক্রিমিনালাইজ) অপরাধী করে ফেলা যায়। এখানে গোয়েন্দা সংস্থা, রাষ্ট্রীয় লোকজন এবং সংবাদপত্রের এক ধরনের সংযোগ কাজ করে। এটি দুভাবে কাজ করে। একদিকে সে সমাজের ভাষাগুলোকে দমন করে। অন্যদিকে সমাজের ভাষাগুলোকে সে শিকার করে’।
আ-আল মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশে শিকারী সাংবাদিকতার মেনিফেস্টো শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে। সে সময় শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করার সময় আমরা শিকারী সাংবাদিকতা দেখেছি। পরে তা বিস্তৃত হতে পারেনি। কিন্তু মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ড বা পরিমণির মাদককাণ্ডে তা পুনরায় প্রতিফলিত হয়েছে’।
শিকারী সাংবাদিকতার বিষয়ে ২২ জন সাংবাদিকের মতামত নিয়েছেন আ-আল মামুন। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা শিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, তার কয়েকটি কারণ তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘সাক্ষাৎকার ও যা সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ২০১০-২০১২ সালের আগে গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে সংবাদ করা যেত। কিন্তু এরপর গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ করা যেত না। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভয় কাজ করে। কারণ বাংলাদেশে চাকরি ও সম্মান একসঙ্গে হারায়। এখানে কেউ চাকরি হারালে তাকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে সম্মান হারানোর ভয়ে সাংবাদিকরা তার মালিকপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে। তৃতীয়ত, যারা গণমাধ্যমের মালিক, তারাই রাষ্ট্র চালায়। গত নির্বাচনে ১৮ জন গণমাধ্যমের মালিক অংশ নিয়েছেন এবং ১২ জন সংসদ সদস্য হয়েছেন। চতুর্থত, মূলধারার গণমাধ্যমের আয় কমে যাওয়ার কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে তাদের মধ্যে এক ধরনের নেক্সাস (সংযোগ) গড়ে উঠেছে। এ শক্তিশালী নেক্সাস শিকারী সাংবাদিকতার উত্থানে ভূমিকা রেখেছে’।
চিন্তক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের একটি দিক হচ্ছে, অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নেওয়া। যেমন টিভির নাম হয়েছে একাত্তর বা একুশে-এগুলো হলো আত্মসাৎকরণ। এগুলো ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। আপনারা বলতে পারেন, এগুলো তো জাতীয় প্রতীক। নাম দেওয়া সমস্যা না, কিন্তু নাম দিয়ে যা করে, তা তো ভয়াবহ’।
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, ‘সাংবাদিকতা শুধু জনমত তৈরি করে না, এটি রাজনৈতিক মতও তৈরি করে। থিউরিও তৈরি করে, ক্ষমতাও তৈরি করে। ফ্যাসিবাদের উদাহরণ হিসেবে বলি- ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্ণ হয়। তখন ঢাকার সেসব পত্রিকা আমি দেখেছি। তারা বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে ১৫০ বছরপূর্তিতে ঢাকার কয়েকটি দুর্বল পত্রিকা ও টিএসসিতে কয়েকজন বামপন্থি কিছু বক্তব্য দিয়েছিল। সরকারিভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। পলাশীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ নেই। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের উল্লেখ নেই। এমনকি ৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে, তারও কোনো স্বীকৃতি নেই’।
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি পাঠ্যবইয়ে রাখা নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। অভ্যুত্থানের সময় যারা বীরের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের পেটানো হয়েছে। তার মানে ফ্যাসিবাদ এখনো জীবন্ত আছে। ফ্যাসিবাদ আমাদের শিক্ষকদের ভেতর আছে, ছাত্রদের ভেতর আছে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের জমানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কী ভুমিকা পালন করেছে, এটা নিয়ে কোনো সমালোচনা না করে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যকে দাওয়াত দিলে পাপমোচন হবে না। এদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া শিকারী সাংবাদিকতার একটি উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময় একদিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাকে ফোন করেন। তিনি আমার কাছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চান। আমি তাকে বললাম শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি যৌক্তিক। পরে দেখলাম সবগুলো মূলধারার গণমাধ্যমে আমাদের এ ফোনালাপটি প্রচার করা হচ্ছে। ‘লন্ডনে বসে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র’ এমন একটি ভাব। হঠাৎ দেখলাম একটি টিভি রাত ১১টায় টকশো ডেকে বসলো। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো উপস্থাপিকা লাইভ অনুষ্ঠানে আমাকে কল করে বসলেন’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মেয়ের পরীক্ষা ছিল এর দুদিন পরেই। পরদিন ২টা পর্যন্ত এ ঘটনা টিভি চ্যানেলের লিড নিউজে ছিল। সরকারের তখনকার দুজন মন্ত্রীও টিভিতে এ ঘটনার রেফারেন্স টেনে কথা বললেন। আমি তখনকার আমার পরিচিত ‘প্রভাবশালী’ সাংবাদিকদের ফোন করলাম। মনে হলো তারা আমার কল পেয়ে ভীত। অনেকে ফোনকলই ধরলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সঙ্গে কথা বললাম। তারা আরও বেশি ভীত-সন্ত্রস্ত। আমি তখন বুঝতেই পারিনি এ ধরনের একটি ব্যক্তিগত ফোনালাপের মধ্যে এমন কী সংবাদ উপাদান রয়েছে, যার কারণে দুদিন ধরে তাকে লিডে রাখা হলো। এভাবে রেকর্ড গ্রহণ করা আইনসিদ্ধ কিনা? তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থা যদি এ রেকর্ড গ্রহণও করে তাহলে এর সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক কী’।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
এফএইচ/আরবি