ঢাকা: বাংলাদেশে প্রতি দশ বছরে একবার অনুষ্ঠিত হওয়া অর্থনৈতিক শুমারি। দেশের আর্থিক পরিস্থিতি এবং জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
তবে এবারের অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্য সংগ্রহের সময় আয়-ব্যয়ের সঠিক তথ্য না পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে। মাঠ পর্যায়ে জনগণ তাদের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব দিতে ভয় পাচ্ছেন, যা শুমারির সঠিক ফলাফল পেতে বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
যদিও শুমারির মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহকারীরা জানান, তথ্য সংগ্রহে কোথাও কোথাও চ্যালেঞ্জ যে নেই-তা নয়, তবে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ও ঢাকা জেলার সাভারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চতুর্থবারের মতো এই অর্থনৈতিক শুমারি পরিচালনা করছে।
প্রতি ১০ বছর পরপর এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যা দেশের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। এবারের শুমারি ২০২৪ শুরু হয়েছে ১০ ডিসেম্বর এবং চলবে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই শুমারির মাধ্যমে সরকার দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছে, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় কাজে লাগবে।
কালীগঞ্জের নাগরি ইউনিয়নের স্বাধীনতা চত্বরের নিশাদ স্টোরে দেখা হয় গণনাকারী মো. হাসমত উলাহর সঙ্গে। তিনি মুদি দোকানদার আসলামের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন। প্রথম দিকে আসলাম তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন, তার আয়ের ওপর কর ধার্য করা হবে কি না। শেষ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহকারী তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এসব তথ্য সরকারি নীতি নির্ধারণের কাজে ব্যবহার হবে। এর সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। পরে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন তিনি।
এদিকে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সুপারভাইজার সেলিনা আক্তার জানান, তিনি ৬ জন তথ্য সংগ্রহকারী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার দলের সদস্যরা মাঠে নেমে জনগণের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন। কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ এবং আন্তরিকতা চোখে পড়ার মতো।
গাজীপুর জেলার শুমারি সমন্বয়কারী মুরশিদা ইয়াসমিন বলেন, আমাদের দায়িত্বে ৭৭৯ জন তথ্য সংগ্রহকারী আছেন। প্রথম দিকে কিছু সমস্যা হলেও তারা দ্রুত সমাধান করেছেন।
সেলিনা আক্তার এবং মুরশিদা ইয়াসমিন জানান, তথ্য সংগ্রহকারীরা মাঠে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলেও তারা একে অপরকে সহযোগিতা করছেন এবং সমস্যা সমাধানে সক্ষম হচ্ছেন।
তবে মাঠ পর্যায়ে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষ করে, অনেক ব্যবসায়ী বা কর্মী তাদের আয়-ব্যয়ের সঠিক তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন।
সুজন, একজন কামার, তার ব্যবসা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার তিনজন কর্মী কাজ করেন, তাদের বেতন দিতে হয়। দোকানের ভাড়া এবং ইউটিলিটি বিলও দিতে হয়। তবে ব্যবসা ভালো না হওয়ার কারণে, আমাকে বাসা থেকে টাকা এনে খরচ চালাতে হয়। এমন অবস্থায় অনেকেই তথ্য দিতে সঠিকভাবে সম্মত হচ্ছেন না, যা শুমারির সঠিক ফলাফল পেতে বাধা সৃষ্টি করছে।
একই সমস্যা তুলে ধরেছেন মুদি দোকানি রহিম মিয়া। তিনি বলেন, আমার আয় নেই, বরং আমি লসে আছি। আপনি আমাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জেনে কি করবেন? সরকার কি আমাকে সাহায্য করবে?" রহিম মিয়ার মত, অনেক ব্যবসায়ীই তথ্য দিয়ে সরকার থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাওয়ার ভয়ে তাদের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব দেন না।
এ ব্যাপারে গাজীপুরের শুমারির গণনাকারী নাজমা খাতুন বলেন, মাঠে তথ্য সংগ্রহের সময় প্রায়ই দেখা গেছে লোকেরা আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব দিতে ভয় পাচ্ছে। তবে, যখন তাদের বোঝানো হয় যে এই তথ্য আয়কর সংক্রান্ত নয়, তখন তারা সহযোগিতা করেছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকারী ও গণনাকারীরা জনগণকে সঠিকভাবে বোঝান যাতে তারা সঠিক তথ্য দিতে পারে।
সাভারের আশুলিয়া জোনাল অফিসার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আশুলিয়ায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই গার্মেন্টস। গার্মেন্টস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কিছু কিছু গার্মেন্টসে ৪-৫ দিন যাওয়ার পরও কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি তথ্য পেতে বেগ পেতে হচ্ছে আয় ব্যয়ের হিসাবে- বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রকল্প পরিচালক এস এম শাকিল আখতার জানান, শুমারির তথ্য সংগ্রহের কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে এবং তারা সঠিক সময়ে এটি শেষ করতে আশা করছেন।
তিনি বলেন, "এবারের শুমারিতে ৭০টিরও বেশি প্রশ্ন থাকবে, যার মধ্যে দেশের আর্থিক অবস্থা, কর্মসংস্থান, ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হবে। " এবারের শুমারিতে বিশেষ করে বিদেশি কর্মীদের পরিসংখ্যানও সংগ্রহ করা হবে, যাতে জানা যাবে, দেশে কতজন বিদেশি কর্মী কাজ করছেন, তারা কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এবং তাদের মধ্যে নারী-পুরুষের সংখ্যা কত।
তবে আর্থিক শুমারি ২০২৪-এর মাধ্যমে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা তৈরি করা সম্ভব। তবে, তথ্য সংগ্রহকারী দলের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অনেকেই তাদের আয়-ব্যয়ের সঠিক তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন। শুমারি সফল হলে, তা দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতিতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
এসএমএকে/আরএ