দিনাজপুর: গেল ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে একের পর এক মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে আসছে ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম।
সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো দিনাজপুরের খানসামায় মা-মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা।
খবরের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘বাংলাদেশে শিশুসহ মাকে মেরে ঝুলিয়ে দিল কট্টরপন্থীরা!’ গত ১৯ ডিসেম্বর গণমাধ্যমটির ইউটিউবে সংবাদটি প্রকাশিত হয়।
এমন খবরে হতবাক হয়েছেন নিহতের স্বজনরাও। প্রতিবেশীরাও বলছেন হিন্দু-মুসলিম সংক্রান্ত কোনো বিষয় নেই এই ঘটনার সঙ্গে। ঐক্য বজায় রাখতে এসব গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান সুশীল সমাজের।
ভারতীয় মিডিয়ায় এমন সংবাদ প্রচারের পর সরজমিনে যাওয়া হয় দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার আরাজি জুগিরঘোপা বেণুপাড়া এলাকার ভক্ত রায়ের বাড়িতে। পাড়া-প্রতিবেশীসহ নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়।
নিহত সুজাতা রানী রায়ের স্বামী ভক্ত রায় বলেন, আমার স্ত্রী পারিবারিক কোনো কারণে আত্মহত্যা করেছেন। এখানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংক্রান্ত কোনো বিষয় নেই। ভারতীয় মিডিয়ায় যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে তার সম্পূর্ণ মিথ্যা। এখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান সকলে মিলে মিশে বসবাস করি। একে অপরের অনুষ্ঠানে যাই। আশপাশের মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের কোনো ক্ষতি না করে না। বরং বিপদে-আপদে তারাই সবার আগে এগিয়ে আসে। আমি চাই না আমাদের এই পারিবারিক বিষয়টি অপপ্রচারের কারণে দেশের মধ্যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হোক।
ভক্ত রায়ের বাবা বিজয় রায় বলেন, আমার ছেলের স্ত্রী হঠাৎ করেই এরকম দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। আমাদের পরিবারের কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। কিন্তু মুসলমান-হিন্দু এরকম কোনো বিষয়ে এখানে নেই। পাশেই আমাদের ইউপি সদস্যদের বাসা। তিনি আমাদেরকে এসব বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করছেন।
প্রতিবেশী ঠাকুর দাস রায় বলেন, হিন্দু-মুসলমান কলহের কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এমন কিছুই ঘটেনি। পারিবারিক ঝামেলা নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমাদের আশপাশে অনেক মুসলমান আছে। আমরা সবাই সুন্দর স্বাভাবিকভাবেই বসবাস করে আসছি।
প্রতিবেশী গঙ্গা রানী রায় বলেন, পাশের বাড়ির সুজাতা রানী দিদি প্রতিদিন দুপুরের পর বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাতেন। ঘটনার দিনও তারা ঘুমিয়েছেন। পরে রাতে যখন ডাকাডাকির পর ওঠেননি তখন দরজা ভেঙে দেখি মা-মেয়ে ঝুলে আছে। এখানে মুসলমান কেউ এসে হামলা করলে তো হইচই হয়ে যেত। আর এখানে মুসলমান যারা আছে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো ঝামেলা নেই।
ওই এলাকায় ইউপি সদস্য আবু তালেব বাবু বলেন, আমার ওয়ার্ডের বেশিরভাগ ভোটারই হিন্দু। এখানে মুসলমানের সংখ্যা কম। আমরা সবাই যুগ যুগ ধরে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে আসছি। ঘটনার দিন আমি ভক্ত রায়ের বাড়িতে যাই। পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি যে, তার স্ত্রী মেয়েসহ পারিবারিক কোনো কারণে আত্মহত্যা করেছে। এখানে মুসলমানদের চাপে আত্মহত্যা বা তাদের দ্বারা হত্যাকাণ্ড হয়েছে এমন কোনো বিষয় নেই। ভারতীয় মিডিয়া এর আগেও এমন অপপ্রচার চালিয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।
পিস ফ্যাসিলিটেটর গ্রুপের (পিএফজি) খানসামা উপজেলা কোঅর্ডিনেটর নুরল হক বলেন, আমাদের উপজেলায় সকল ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ বসবাস করে। এখানে মুসলমানদের দ্বারা হিন্দু নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আছে যারা মা-মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা তদন্ত করে দেখছে।
এ বিষয়ে দিনাজপুর সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ জিন্নাহ আল মামুন বলেন, ঘটনার দিন খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল থেকে সুজাতা রানী রায় ও তার মেয়ে নীলাদ্রি রায়ের মরদেহ উদ্ধার করি। প্রাথমিক সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের পর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। মরদেহের পাশে একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এটি আত্মহত্যা। ময়না দন্তের প্রতিবেদন পেলে সঠিক কারণ জানা যাবে।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার আরাজি জুগিরঘোপা বেণুপাড়া এলাকার ভক্ত রায়ের স্ত্রী সুজাতা রানী রায় ও তার মেয়ে নীলাদ্রি রায়ের ঝুলন্ত মরদেহ নিজ ঘর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে এর আগেও ক্রিকেটার মাশরাফির বাড়ি পোড়ানোর ঘটনাকে লিটন কুমার দাসের বাড়ি বলে অপপ্রচারসহ নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে হামলার অপপ্রচার চালায় ভারতের বেশ কয়েকটি মিডিয়া। এছাড়া পঞ্চগড় দিয়ে ভারতে কিশোরীর অনুপ্রবেশকে ইসকনের ভক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে তাকে ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার ও সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রমে সব থেকে এগিয়ে কলকাতার বিতর্কিত সাংবাদিক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ, তার গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলা।
একই সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ, লাইভ মিন্ট, ইন্ডিয়া টুডে, রিপাবলিক, আজতাক, এবিপি আনন্দসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক বার্তা ছড়ানো হচ্ছে।
পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার গুজব, বাংলাদেশে মুসলমানদের হামলায় মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে যুক্তরাজ্যের এমন ভ্রমণ সতর্কতা জারির মতো এমন সব বিভ্রান্তিকর খবরে সয়লাব ভারতীয় মিডিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
এসএএইচ