ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

১৫ টাকার চালের কার্ড নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা মিলল তদন্তে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৮ ঘণ্টা, মে ৭, ২০২৪
১৫ টাকার চালের কার্ড নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা মিলল তদন্তে

লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১৫ টাকা কেজিদরের চালের কার্ড নিয়ে ওঠা নয়-ছয়ের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

মঙ্গলবার (৭ মে) দুপুরে বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুর ই আলম সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, দীর্ঘ আট বছর আগে গোপনে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুফলভোগীর তালিকায় একই পরিবারে দুটি কার্ড করে নিয়ে চাল আত্মসাৎ করে আসছিলেন এনামুল হক ভরসা নামে এক ডিলার। এর বিচার চেয়ে দিনমজুর দম্পতি মমিনুর ইসলাম ও ছকিনার করা অভিযোগটির সত্যতা মিলেছে। একই সঙ্গে এ অভিযোগ করার পর তাদেরই উল্টো শোকজ করার বিষয়টিরও সত্যতা মিলেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করে জেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটি। জেলা কমিটি যা নির্দেশনা পাঠাবে, সেটা বাস্তবায়ন করা হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগকারী দিনমজুর মমিনুর ইসলাম উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মহিষাশ্বর ম্যালম্যালির বাজার এলাকার মৃত আব্দুস সামাদের ছেলে। ছকিনা খাতুন তার স্ত্রী।

অভিযোগে জানা গেছে, হতদরিদ্র শ্রমিক দিনমজুর পরিবারের মানুষদের মাঝে স্বল্প মূল্যে চাল বিক্রি করতে সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করে। প্রথম দিকে ভর্তুকি মূল্যে ১০ টাকা কেজিদরে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে চাল বিক্রি শুরু করে সরকার। পরবর্তীকালে দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা কেজিদর করা হয়। স্থানীয়রা এ কারণে এ কার্ডকে ১০ টাকার কার্ড নামেই জানেন।

অভিযোগ উঠেছে, হতদরিদ্র দিনমজুরদের জন্য স্বল্প মূল্যে চাল বিক্রি করতে সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করে। প্রথমদিকে ভরতুকি মূল্যে ১০ টাকা কেজিদরে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে চাল বিক্রি শুরু করে সরকার।

পরে দাম বাড়িয়ে ১৫ টাকা কেজিদর করা হয়। স্থানীয়রা এ কারণে এ কার্ডকে ১০ টাকার কার্ড নামেই জানেন।

আরও পড়ুন: 
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে শোকজ পেলেন দিনমজুর দম্পতি 
দুর্নীতির অভিযোগকারীকে শোকজের ঘটনায় তদন্ত শুরু

অভিযোগ উঠেছে, উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার এনামুল হক ভরসা চালের কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে ২০১৬ সালে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের কাছ থেকে তার ও তার মায়ের পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করেন। পরিচয়পত্র নিয়ে উপজেলা খাদ্য অফিস থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড করলেও তা মমিনুর ইসলামের কাছে গোপন রাখেন ডিলার ভরসা। গত ১৮ সালে মমিনুর ইসলামের মা রশিদা বেগম মারা গেলেও তার নামে বরাদ্দের চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন ডিলার এনামুল হক ভরসা।  

অপরদিকে গেল বছর সরকার কার্ডধারীদের তথ্য ডিজিটাল করায় বিপাকে পড়েন ডিলার এনামুল হক ভরসা। কারণ কার্ডধারীর আপডেট ছবি ও আঙুলের ছাপ লাগবে। তখন কৌশলে ডিলার এনামুল হক ভরসা মৃত কার্ডধারী রশিদার পুত্রবধূ ছকিনার নামে কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে ছকিনা ও তার স্বামী মমিনুর ইসলামের ছবি ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেন।

এরপর মৃত রশিদার স্থলে তার পুত্রবধূ ছকিনার নামে কার্ড তৈরি করেন ডিলার ভরসা। একই সঙ্গে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের নামের কার্ডের তথ্যও ডিজিটালে হালনাগাদ করে কার্ড দুটি নিজের কাছেই রেখে দেন ডিলার এনামুল হক ভরসা। স্ত্রী ছকিনার নামের কার্ডটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে মমিনুর ঘুরেছেন ডিলারের দুয়ারে।

গত মাসের চাল বিতরণকালে উপজেলা খাদ্য বিভাগ ডিলারদের মধ্যে কার্ডধারীদের তালিকা নতুন করে বণ্টন করে। এতে শফিকুল ইসলাম নামে এক ডিলারের হাতে পড়ে মমিনুরের স্ত্রী ছকিনার নামের কার্ড। সেই কার্ডে চাল নিতে আসেন ডিলার এনামুল হক ভরসার দোকানের কর্মচারী নাইম। এতে সন্দেহ হওয়ায় ছকিনা বেগমকে ফোন করেন নতুন ডিলার শফিকুল ইসলাম। তখন মমিনুরের পরিবার জানতে পারে, ছকিনার নামে খাদ্যবান্ধবের কার্ড হয়েছে। ছকিনাদের কাছে কার্ড হয়েছে স্বীকার করলেও পাঁচ হাজার টাকা না দিলে কার্ড দেবে না বলে সাফ জানান ডিলার এনামুল হক ভরসা।

নিরুপায় দিনমজুর মমিনুর ইসলাম অল্প দামে চাল পেতে ডিলার ভরসাকে ঋণে নেওয়া দুই হাজার টাকা দেন কার্ডটি ফেরত পেতে। টাকা নিলেও কার্ড বা চাল কোনোটাই দেননি ভরসা। উপজেলা খাদ্য অফিসে গিয়েও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী দিনমজুর মমিনুরকে সহায়তা করেননি। বরং ডিলার ভরসার বিরুদ্ধে না গিয়ে তার কথামতো চলতে বলা হয়।

তিনি পরে অন্য মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালুর দিন থেকে দিনমজুর মমিনুর ইসলামের নামে কার্ড ও চাল বরাদ্দ ছিল, যার কার্ড নম্বর-১৬৯ এবং তার মৃত মা রশিদার পরিবর্তে তার স্ত্রী ছকিনার কার্ড নম্বর-১৪৮০। পরিবারে দুটি কার্ড থাকার পরও এক ছটাক চালও কিনতে পারেননি মমিনুর ইসলাম-ছকিনা দম্পতি।

অবশেষে ২৭ মার্চ তাদের নামে বরাদ্দকৃত খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড ও দীর্ঘদিন ধরে আত্মসাৎ করা চাল উদ্ধার এবং অভিযুক্ত ডিলার এনামুল হক ভরসার বিচার দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মমিনুর ইসলাম।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক, সমবায় ও সহকারী প্রোগ্রামারকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন ইউএনও। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক নিজে আপস করার জন্য চাপ দেন বলে দাবি করেন অভিযোগকারী। এতে সম্মতি না দেওয়ায় অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে গত ১৮ এপ্রিল শোকজ লেটার পাঠান উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক হাসনা আকতার। সেখানে দুই কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দাখিল করতে ব্যর্থ হলে তাদের উভয়ের কার্ড বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী মমিনুর ইসলাম বলেন, দীর্ঘ আট বছর ধরে আমার পরিবারের নামে দুটি কার্ড করে বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল আত্মসাৎ করেছেন ডিলার এনামুল হক ভরসা। এতদিন খাদ্যবিভাগ তা চোখে দেখল না। আমি অভিযোগ দিলাম দুর্নীতিবাজ ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, এখন তারা দুর্নীতিবাজকে বাঁচাতে তথ্য গোপন করে না কি আমরা সরকারি সুবিধা আত্মসাৎ করেছি। তাই আমাকে শোকজ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। শোকজের জবাব দিয়েছি। বিচার না পেলে প্রয়োজনে আদালতে যাব। আমার পরিবারের নয়, ১৫৮৩ নম্বর কার্ডটিও ডিলার এনামুলের স্ত্রী ফাতেমার। অনেকের নামে কার্ড করে চাল আত্মসাৎ করছেন ডিলার। তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে।

এমন অভিযোগে খবর প্রকাশিত হলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু করেন রংপুর আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রক।  

অপরদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গঠন করা তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে সোমবার (৬ মে) উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটিতে তা উপস্থাপন করা হয়। সেখানে অভিযোগকারীর দাখিল করা সব তথ্যই সঠিক এবং উল্টো তাকে শোকজ করার ঘটনারও সত্যতা পেয়েছে কমিটি। অভিযুক্ত ডিলার ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে জেলা খাদ্যবান্ধব কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন ও রেজুলেশন পাঠিয়েছে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটি।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, অভিযুক্ত ডিলারের লাইসেন্স বাতিলসহ চাল আত্মসাৎ করার দায়ে জেল জরিমানাও হতে পারে। জেলা কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। বাদীর পুরো অভিযোগেরই সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।  

আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুর ই আলম সিদ্দিকী বলেন, অভিযোগকারীর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। অভিযুক্ত ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির কাছে সুপারিশ করেছে উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটি। জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত পেলেই তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।  
 

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০২৪
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।