চট্টগ্রাম: দিন দিন দূষণের নগরীতে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম। এক সময়ের ক্লিন সিটি চট্টগ্রামে বায়ু দূষণের পাশাপাশি বেড়েছে শব্দ দূষণও।
প্রতি মাসে চট্টগ্রাম নগরের মোট ৩০টি স্থান থেকে শব্দ দূষণের তথ্য সংগ্রহ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। শুধু গত নভেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি স্থানে সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ডেসিবল বেশি শব্দদূষণ। শুধু শিল্প এলাকায় নয়, নগরের আবাসিক ও নীরব এলাকায়ও একই চিত্র।
নভেম্বরে সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী, পাহাড়তলী গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭০ ডেসিবল, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ৬৫ ডেসিবল, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) সামনে ৬০ ডেসিবল, চিটাগাং গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৬৪.৫ ডেসিবল, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলের (বাওয়া) সামনে ৭০ ডেসিবল, ডা. খাস্তগীর গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৬৯ ডেসিবল, চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ৫৫.৫ ডেসিবল, সিটি কলেজের সামনে ৬৪.৫ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সামনে ৭৩ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিক্যাল কলেজের সামনে ৬৯ ডেসিবল, আন্দরকিল্লা জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে ৬৭ ডেসিবল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের সামনে ৭৪ ডেসিবল, এ কে খান আল আমিন হসপিটালের সামনে ৬৫.৫ ডেসিবল, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটালের সামনে ৭১ ডেসিবল, পূর্ব নাসিরাবাদের সাউদার্ন হসপিটালের সামনে ৭৩ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়।
আবাসিক এলাকায় শব্দের মানমাত্রা ৭৬ ডেসিবল হলেও নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ৬৪.৫ ডেসিবল, আমিরবাগ আবাসিকে ৬০ ডেসিবল, হালিশহর কে-ব্লক আবাসিকে ৭৪.৪ ডেসিবল, কল্পলোক আবাসিকে ৬৮ ডেসিবল, হিলভিউ আবাসিকে ৭০.৫ ডেসিবল, কসমোপলিটন আবাসিকে ৭০ ডেসিবল ও খুলশী (দক্ষিণ) আবাসিকে ৬৯ ডেসিবল শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়।
আবার শিল্প এলাকা হিসেবে মানমাত্রা ৬০ ডেসিবল থাকার কথা থাকলেও মুরাদপুর একুশে হাসপাতালের সামনে ৬৯ ডেসিবল ও মেহেদীবাগ ম্যাক্স হাসপাতালের সামনে ৭০ ডেসিবল মাত্রায় শব্দদূষণ পাওয়া যায়। একইভাবে বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল শব্দের মানমাত্রা থাকলেও নগরীর এ কে খান মোড়ে ৭৫ ডেসিবল, জিইসি মোড়ে সর্বোচ্চ ৭৬.৫ ডেসিবল, বহদ্দারহাট মোড়ে ৭৬ ডেসিবল, আগ্রাবাদ মোড়ে ৭৬ ডেসিবল, সিইপিজেড মোড়ে ৭৭ ডেসিবল ও অক্সিজেন মোড়ে ৮২ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন থাকলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায় শব্দদূষণ কমছে না। তাই আইনকে আরও যুগোপযোগী করার দাবি তাদের।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এ শব্দদূষণের অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। এ আইনের ১৭ ধারার ১ উপধারায় উল্লেখ করা হয়, ১০ ধারার উপ-ধারা (১) এর দফা (ক) এবং (ঙ) এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের সময়, এই বিধিমালার অধীন দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার হতে পারে এমন কোনো শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রপাতি বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরঞ্জামাদি আটক করতে পারবেন।
এছাড়া একই আইনের ১৮ ধারা ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ১৫ এর উপধারা (২) এর বিধান অনুসারে এই বিধিমালার বিধি ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২ এবং ১৩ এর বিধান লংঘন এবং বিধি ১৪, ১৫ এবং ১৬ এ প্রদত্ত নির্দেশ পালনের ব্যর্থতা, অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।
অন্যদিকে একই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি উপ-বিধি (১) এর অধীন নির্ধারিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ১ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
আইনে উল্লেখ থাকলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায় শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে বলে দাবি দূষণ নিয়ে কাজ করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ইকবাল সরওয়ারের।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শব্দদূষণ এমন একটি বিষয়- জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দূষণের মত এটিও বাড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ হয় যানবাহন থেকে। এছাড়া নগরায়নের ফলেও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, কল-কারখানা স্থাপনে শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে।
শব্দদূষণ রোধে যে আইন রয়েছে এটি যুগোপযোগী কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, শব্দদূষণ আইন হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন সংশোধন করা দরকার। কারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। ১০-১৫ বছর আগে মানুষের যে আয় ছিল এখন তা দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়েছে। ফলে আইন ভঙ্গ করলেও জরিমানা দিতে অনেকের গায়ে লাগছে না। তাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন সংস্কারের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।
এই গবেষকের মতে, চালকদের মধ্যে একটা প্রবণতা রয়েছে- কে কার আগে যাবে। কেউ এক মিনিট অপেক্ষা করতে চায় না। ফলে রাস্তায় কারণে অকারণে হর্ন বাজিয়ে থাকে। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। সবচেয়ে বড় বিষয়, চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে হর্ন ব্যবহারের নিয়মনীতি সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে তা যাচাই-বাছাই করা উচিত।
মাত্রাতিরিক্ত শব্দে মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিটন চাকমা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অধিক শব্দ দূষণের ফলে মাথা ব্যথা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার মত সমস্যায় ভুগে মানুষ। যা পরবর্তীতে উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ সহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই শব্দদূষণ রোধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনকে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। দূষণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
তিনি বলেন, শুধু মানসিক অবসাদগ্রস্ততা ছাড়াও অতিরিক্ত শব্দদূষণে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন শব্দ দূষণের মধ্যে থাকলে বধির হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের পরিচালক নাসিম ফারহানা শিরীন বাংলানিউজকে বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা বিভিন্ন স্পটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে জরিমানা করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা প্রায় গাড়ি হলো প্রভাবশালীদের। এতে জরিমানা আদায় করতে আমাদের বেগ পেতে হয়। তারপরও আমাদের অভিযান চলমান। পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে অভিযান আরও বেশি চালানো যেত।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
এমআর/টিসি