মানুষ চেনা আসলেই খুব সহজ কাজ নয়। সারা জীবন একসাথে বসবাস করেও স্বামী চিনতে পারে না স্ত্রী’কে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষ চিনতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতিও তাকে চিনেছিল। মানুষের মন ও স্বপ্নকে চিনতে পেরেছিলেন বলেই পুরো জাতি জেগে উঠেছিল তাঁর কথায়। তারপরও তিনি চিনতে পারেন নি বন্ধু-রূপী শত্রুদের।
কাছের শত্রুদের নিয়ে একটি চমৎকার গবেষণা করেছেন আশীষ নন্দী। এমন শত্রুদের নাম দিয়েছেন তিনি ‘ইন্টিমেট এনিমি’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘আন্তরিক শত্রু’। গবেষণার মূল কথাই হলো, শত্রু নামে মানুষ যাদের চেনে বা জানে, তারা যত না ক্ষতি করতে পারে, তাদের চেয়ে যাদেরকে চেনে বা বন্ধু-স্বজন বলে জানে, তারাই অনেক বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। ইতিহাসের পাতা থেকে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বহু উদাহরণ টেনে তিনি দেখিয়েছেন, শত্রুদের চেয়েও ভয়ংকর শত্রু হলো কাছের মানুষ বা ‘আন্তরিক শত্রুরা’। অনেকটা ইসলাম ধর্মের ‘মোনাফেক’-এর মতো। শত্রুদের চেনা যায়। বন্ধুরূপী, স্তাবকরূপী, স্বজনরূপী শত্রুদের চেনা যায় না বলেই এরা অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যারা হত্যা করেছিলেন, তারা কেউ অচেনা মানুষ ছিলেন না। একজন ছিলেন মেজর ডালিম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শেখ কামাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হলে ডালিম তার সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন ডালিম। কথিত আছে, বঙ্গবন্ধুর দয়ায় ও আনুকূল্যে ডালিম কিছু ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধাও হাতিয়ে নেন। ঘাতক দলে ছিলেন রশীদ ও ফারুক, পরস্পরের ভায়রা ভাই। রশীদ ছিলেন মোশতাকের ভাইপো। বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলামের আত্মীয় মেজর নূর ছিলেন ঘাতকচক্রের আরেকজন। আত্মীয়তা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক সূত্রে ঘাতকরা ছিল একাট্টা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারেরও চেনা-জানা ছিল ঘাতকরূপী মানুষগুলো।এসব চেনা মানুষের চক্রান্তের জাল নানাভাবে বিছানো ছিল বঙ্গবন্ধুর চারপাশে। হত্যাকাণ্ডের পর পরই সকাল ৯টার দিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কুচক্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এতে অনেক তথাকথিত আওয়ামী লীগ নেতাও যোগদান করেন, যারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কর্মী বা প্রিয়ভাজন। অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। অধিকাংশই মোশতাককে সমর্থন জানান।
১৫ আগস্ট মোশতাক তাৎক্ষণিক এক বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী সামরিক অফিসারদের ‘সূর্য সন্তান’ বলে উল্লেখ করেন। অথচ এই মোশতাকের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিল নিবিড় ও বহু বছরের পুরনো। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ১৪ এপ্রিল ১৯৬৭ সালের বিবরণে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন (পৃষ্ঠা ২২২):
“আজ বাংলা নববর্ষ। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দি কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেলে আমার দেওয়ানীতে এসে হাজির। আমাকে কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল। ২৬ সেল হাসপাতাল থেকে বন্ধু খোন্দকার মোশতাক আহমদও আমাকে ফুল পাঠাইয়াছিল। আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলী খান, সিরাজুল হোসেন খান ও মৌলানা সৈয়াদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান. মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক সাহেবকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে। ”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু কারাগারের দিনগুলোতে নিজের লেখা ডায়েরিতে খোন্দকার মোশতাক আহমদকে ‘বন্ধু’ বলে লিখেছেন। কে জানত ‘বন্ধু’ একদিন প্রাণঘাতী শত্রুতে পরিণত হবেন! বঙ্গবন্ধু তাঁকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুল পাঠিয়েছিলেন। মোশতাকও বঙ্গবন্ধুকে ফুল পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কি জানত, সেই ফুল একদিন বুলেটে পরিণত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বুকে এসে বিঁধবে? রক্ত ঝরাবে? প্রাণ কেড়ে নেবে?খুবই কাছের ‘আন্তরিক শত্রুরা’ রূপ ও গন্ধময় ফুলের সৌন্দর্য্যরে আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোপন কাঁটার মতো। কখন যে সে কাঁটা মোক্ষম জায়গায় আঘাত হানবে, কেউ জানে না। ‘আন্তরিক শত্রুদের’ চিনতে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে। তেল ও ফুল হাতে বন্ধু পরিচয়ে চারপাশে ঘিরে থাকা ‘আন্তরিক শত্রুদের’ কি একালের নেতা-নেত্রীরা ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছেন?
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-শিক্ষাবিদ। প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৭
জেডএম/