ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ বৈশাখ ১৪৩২, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তরুণ রাজনীতিবিদদের জন্য অনুকরণীয় একজন

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০২৫
তরুণ রাজনীতিবিদদের জন্য অনুকরণীয় একজন গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার কার্যালয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে করমর্দন করেন। ছবি : পিআইডি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন তরুণদের জয়জয়কার। জুলাই বিপ্লব তরুণদের রাজনীতির আগ্রহ যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি তাদের সক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে।

তরুণরাও পারে, দেশকে তারা পথ দেখাতে পারে, জনগণের বিপদে তারাই উদ্ধারকর্তা—এই বিশ্বাস জনমনে আরো দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছে জুলাই বিপ্লবে। স্বৈরাচারের পতন একদিকে যেমন তরুণসমাজের সক্ষমতার প্রমাণ, তেমনি তাদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহের সাক্ষ্য।

একসময় মনে করা হতো, তরুণরা রাজনীতিবিমুখ। দেশ নিয়ে তারা ভাবে না। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো যেকোনোভাবে লেখাপড়া শেষ করে হয় দেশের বাইরে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া, না হলে একটা ভালো চাকরি করা। সমাজের চারপাশ থেকে তারা নিজেদের গুটিয়ে রাখতে চায়।

সমাজের অবক্ষয়, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, অন্যায়, অত্যাচার তাদের তাড়িত করে না। তারা তাদের নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখতে চায়। তরুণরা শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর—এমন একটি ধারণা হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে তরুণদের উদাসীনতা একটি বড় উদ্বেগ তৈরি করেছিল সচেতন মানুষের মধ্যে।

কিন্তু জুলাই বিপ্লব সেই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। তরুণরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আর এই কারণেই তরুণদের নিয়ে জনগণের আশাবাদ বেশি; এটি তরুণদের খুলে দিয়েছে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন যেন সফল হয়, এর যে প্রত্যাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষা তা যেন বাস্তবায়িত হয় সে জন্য তরুণরা তাদের সংগ্রাম এবং প্রত্যয় অব্যাহত রেখেছে। এ কারণেই তরুণরা যেমন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে তারা নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে।

তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন তারা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে চায়। এ জন্য নিজেরাই রাজনৈতিক সংগঠন করেছে।

তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের এই উত্থান শেষ পর্যন্ত কতটুকু স্থায়ী হবে বা শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না, তা এখনো পরীক্ষার বিষয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে তরুণ্যের এই দ্রোহ আমরা দেখেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তরুণদের একটা বড় অংশ হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে।  

আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তারুণ্যের উদ্দীপনা দেখেছিলাম, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর সেই উদ্দীপনা বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকে যায়। আমরা তরুণদের নেতৃত্বে জাসদের উত্থান দেখেছিলাম, কিন্তু সেই উত্থান শেষ পর্যন্ত নানা রকম মত-পথের পার্থক্য এবং ভুল আদর্শে বিপথগামী হয়। এবার বাংলাদেশ তরুণদের পথ হারানো দেখতে চায় না। আর সেই কারণেই তরুণদের সামনে প্রয়োজন কিছু দৃষ্টান্ত, অনুকরণীয় উদাহরণ।

আমাদের তরুণদের সামনে আদর্শের বড় অভাব। তারা যেমন মুহাম্মদ ইউনূসকে বেছে নিয়েছে, যিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে আইকন। বিশ্বের তরুণদের উদ্দীপ্ত করার ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের তুলনা শুধু তিনিই। শুধু তা-ই নয়, তরুণদের আত্মকর্মসংস্থান, তাদের স্বপ্নের আকাশকে আরো বড় করার জন্য অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও তরুণরা রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার জন্য আরো কাউকে অনুসরণ করতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারুণ্যের অন্যতম অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি এমন এক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন, যখন তরুণরা ছিল পুরোপুরি রাজনীতিবিমুখ, নিজের ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আরাম-আয়েশে জীবন উপভোগেই ছিল বেশি আগ্রহী। তারেক রহমানের সামনে বিলাসিতার জীবন উপভোগের সুযোগও ছিল।  

২০০১ সালে বিএনপি যখন ভূমিধস বিজয় পায়, তখন তারেক রহমান টগবগে এক তরুণ। তার মা দেশের তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় তিনি আরাম-আয়েশের জীবনে গা ভাসাতে পারতেন। দেশ ও জাতি নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা না করলেও হতো। বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি যে এ রকম রাজনীতিবিদের সন্তানরা রাজনীতিবিমুখ হন। দেশ ও জনগণের চেয়ে নিজেদের চিন্তায় তারা মগ্ন থাকেন। কিন্তু তারেক রহমান ছিলেন তার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ২০০১ সালের আগে থেকেই তিনি রাজনীতিতে পুরোপুরি নিবেদিত হন। তার রাজনীতির মূল লক্ষ্য ক্ষমতা নয়, বরং তিনি তৃণমূলের সঙ্গে একটি সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমানের পর তারেক রহমানই হলেন একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। সারা দেশে তৃণমূলের জাগরণের নায়ক তিনি। তারেক রহমানের এই রাজনীতির যাত্রাপথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তাকে নানা রকম রাজনৈতিক কুৎসা ও গুজবের শিকার হতে হয়েছে। তার রাজনীতির যাত্রাপথকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র। তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, হয়েছে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা। তাকে কলঙ্কিত করার জন্য গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচার করা হয়েছে। আমরা দেখেছি, এক-এগারোর সময় তারেক রহমান হয়েছিলেন মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার। বাংলাদেশের প্রচলিত নামি-দামি গণমাধ্যমগুলো তার বিরুদ্ধে নানা রকম কলঙ্ক লেপনের অহর্নিশ চেষ্টা করেছিল তৎকালীন বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টারত সরকারের যোগসাজশে।  

কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে তিনি দমে যাননি, লক্ষ্যচ্যুত হননি। এক প্রতিকূল অবস্থায় তিনি তার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। আর সে কারণেই নির্মমভাবে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে। নির্যাতন করে শারীরিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা করা হয়েছিল। অবশেষে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় তারেক রহমান বিদেশে গিয়ে তাঁর লক্ষ্য ও আদর্শচ্যুত হননি। বরং তিনি তার তারুণ্যের শক্তির এক ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। বিদেশে থেকেও তিনি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নীরবে-নিভৃতে লড়াই করে গেছেন। ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রায়ই বলা হয় যে তরুণদের ধৈর্য নেই। তারা একটা কাজে দীর্ঘদিন লেগে থাকতে পারে না। এই অভিযোগ যে সব ক্ষেত্রে মিথ্যা, এমনটিও নয়।  

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তরুণরা সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং নানা রকম সমালোচনা তারা নিতে পারে না। আশাহত হয়ে তারা সব কিছু থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তারেক রহমান ছিলেন আশ্চর্য এক ব্যতিক্রম। তিনি এসব মিথ্যা সমালোচনায় বিভ্রান্ত ও হতাশ হননি। বরং নিবিষ্ট মনে তার লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করে গেছেন, সংগ্রাম করেছেন। আজ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিএনপি তীব্র প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত ও শক্তিশালী আছে শুধু তারেক রহমানের বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার কারণে। আর এখানেই তরুণদের জন্য তিনি অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারেন।

জুলাই বিপ্লবের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তরুণদের নিয়ে নানা রকম অপপ্রচার, তাদের নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণদের হেয় প্রতিপন্ন করা, তাদের অর্জনকে খাটো করার জন্য নানা রকম হীন ষড়যন্ত্র চলছে। এর ফলে অনেক তরুণই হতাশ হচ্ছে। তারা রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। আবার অনেক তরুণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার ভার সামাল দিতে পারছে না। এই দুটি ক্ষেত্রেই তারেক রহমান হতে পারেন অনুকরণীয় প্রেরণা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিপুল বিজয় পেয়েছিল তারেক রহমানের চিন্তা-পরিকল্পনার কারণে। কিন্তু এরপর তিনি সবজান্তা হয়ে ওঠেননি।  

প্রবীণ ও নবীনদের সমন্বয় ঘটিয়ে দলকে সংগঠিত করেছিলেন, ছিলেন বিনয়ী; যেটি আজকের বিজয়ী তরুণদের জন্য আরাধ্য শিক্ষণীয় হতে পারে। তরুণরা যদি মাটিতে পা রাখতে না পারে, যদি মনে করে যে তারা অজেয়, তারা সব বোঝে, তাদের চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না, সেটি তাদের ভুল হবে। বরং তারেক রহমানের মতো প্রবীণ ও নবীনদের সমন্বয়ে যদি তারা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যায়, সেটাই হবে তাদের জন্য মঙ্গল।  

দ্বিতীয়ত, একটি বিজয়ের পর বিজয়ীদের আক্রমণ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়। তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা হয়। যেমনটি হয়েছিল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের পর থেকেই। সে ক্ষেত্রেও তারেক রহমান হতে পারেন তরুণদের জন্য প্রেরণার উৎস। এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে কুৎসিত আক্রমণের বিরুদ্ধে কিভাবে নিজেদের ঠিক রাখতে হয়, সঠিক পথে প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার উদাহরণ হতে পারেন তারেক রহমান। আর এ কারণেই আজ যে তরুণরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে এগোচ্ছে, সেই বন্দোবস্তে তারেক রহমান হতে পারেন তাদের আদর্শ। তাদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তরুণরা বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথের অনিবার্য একটি নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা যেন শেষ পর্যন্ত আবার হাল ছেড়ে না দেয়, তাদের এই অংশগ্রহণ যেন রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থাকে, সেটি তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা যেমন ড. ইউনূসের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানকে অনুসরণ করবে, তেমনি তারেক রহমানের এই উত্তাল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে তারা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তাহলে তারা ধৈর্যশীল হবে, ধীরস্থির হবে এবং প্রতিকূলতা মোকাবেলার সাহস পাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০২৫
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।