ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিচারের দাবি নিয়ে এসেছি

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৫
বিচারের দাবি নিয়ে এসেছি ছবি : প্রতীকী

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমের কল্যাণে ইতিমধ্যেই আমরা সবাই পহেলা বৈশাখের সেই কলঙ্কিত সন্ধ্যার কথা জেনে গেছি। আমরা শুনেছি, পড়েছি এবং দেখেছি আমার মা-বোন-কন্যার উপর একদল বেজন্মা পুরুষের যৌন তাণ্ডব, কতিপয় জন্মান্ধ-বধির পুলিশের ক্ষমাহীন অক্ষমতা এবং আমজাদ আলী নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নপুংশক প্রক্টরের চরম দায়িত্বহীনতা।



প্রকাশ্যে, টিএসসির কাছের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের কাছে এমন অসভ্য-বর্বর-নির্মম একটা ঘটনা ঘটেছে, অথচ আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিয় পুলিশ বাহিনী তার কোন প্রমাণ এখনো পাননি। ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোর বরাত দিয়ে ফেসবুকে তাহলে ওসব কীসের ছবি দেখছি আমরা?

আমাদের দেশের আইন কি এতোটাই অন্ধ যে, যে সব মেয়ে সেদিন যৌন সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন, তারা এসে প্রমাণসহ অভিযোগ দায়ের না করা পর্যন্ত আমরা অনঢ়, অসহায় হয়ে মুখে আঙুল দিয়ে বসে থাকব? আর কতিপয় সুশীল এখন বাংলাদেশের মেয়েদের পোষাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নিয়ে গবেষণায় মত্ত, কার শাড়ির স্বচ্ছতায় তরুণীর নাভির কতোটুকু দৃশ্যমান হলে তা একজন পুরুষের যৌন তাণ্ডবকে হালাল করে সেই হিসেব নিয়ে চরম ব্যস্ত।

মাঝখান দিয়ে ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পার হতে চললো, একজন যৌন সন্ত্রাসীকেও গ্রেফতার পর্যন্ত করা গেলো না। নারীর অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে আমরা সবাই যে যার মত কেবল ত্যানা প্যাঁচাতেই ব্যস্ত, আসল কাজের কোন খবর নাই। অথচ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের আশু করণীয় বিষয়গুলো হওয়া উচিত:

১. পুলিশ সনাক্ত করতে না পারুক, বেসরকারি উদ্যোগে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলো দেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হোক। সুবিচার নিশ্চিত করা গেলে অপরাধের মাত্রা কমতে বাধ্য। এই যে পশ্চিমা দেশের পানশালা কিংবা ডিস্কোতে এত মদ্যপান, সংক্ষিপ্ত পোষাকে তরুণীদের অবাধ চলাফেরা, অথচ সেখানে তো প্রতিনিয়ত যৌন সন্ত্রাস-ধর্ষণ চলছে না। কারণ এসব দেশে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবার সংস্কৃতি অনুপস্থিত।

২. অপরাধীরা কোন সঙ্ঘবদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য কি না তা খুঁজে বের করা হোক। আমরা জানতে চাই এই নজিরবিহীন, পরিকল্পিত যৌন সন্ত্রাস কি বাঙালির সার্বজনীন-অসাম্প্রদায়িক উৎসব নববর্ষের বিরুদ্ধে বৃহত্তর কোন ষড়যন্ত্রের অংশ কি না? রমনার বটমূলে গ্রেনেড হামলা করে যা পারেনি, এই সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করার কোন অপচেষ্টা এখানে কাজ করেছে কি না?

৩. কয়েকজন অপরাধীকে ধরিয়ে দেবার পরেও যে পুলিশ কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তাকেও আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। তিনি কেন অপরাধীদের ছেড়ে দিলেন তার কারণ জানাটা জরুরি। পুলিশ কর্মকর্তার কাছে কি এই ঘটনাকে অপরাধ বলে মনে হয়নি? বড় জানতে ইচ্ছে করে, আমাদের সর্বস্তরের পুলিশের প্রশিক্ষণের সময় নৈতিকতার বিষয়টিতে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে?

৪. আমজাদ আলীকে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদ থেকে অপসারণ করা হোক। এই শিক্ষকের জানা উচিত ছিল যে, ঘটনা শোনামাত্র তার সেখানে ছুটে যাওয়াটা জরুরি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তার উপস্থিতিতে অন্তত আমরা এই মর্মে আশ্বস্ত হতাম যে, তিনি ঘটনা প্রতিহত না করতে পারলেও অন্তত আমাদের পাশে ছিলেন। যদিও আমার ধারণা, ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতিতে হয়তো পরিস্থিতি বদলে যেতে পারত, আশপাশের সাধারণ মানুষ হয়তো তখন প্রতিরোধের মিছিলে শামিল হতো। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, অনেকটা কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বের হবার মতই জানা গেলো যে, এই প্রক্টর মহাশয়ের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের ছোট ছোট চা-পানের দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়সহ নানাবিধ কুকর্মের অভিযোগ আছে।

মফস্বলের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য একজন শিক্ষক হিসেবে আমার ভাবতে খুব কষ্ট হয়, আমজাদ আলীর মত মানুষরা কী করে একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হতে পারেন! শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক দলবাজি আমাদের কোন গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখব না?

এই দাবিগুলো অচিরেই মানতে হবে, নারীর সন্মান রক্ষায় এর কোন বিকল্প নাই। এরপর আমরা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাই বহুমাত্রিক, তা নিরসনে সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবেও আমাদের অনেক কিছু করার থাকে। বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় সবস্তরেই নৈতিকতার ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। নৈতিকতার প্রথম পাঠটি পাবার কথা নিজের পরিবার থেকে, তারপর সমাজের কাছ থেকে। নৈতিকতা বিনির্মাণে শিক্ষারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।   সর্বপরি রাষ্ট্রের তো একটা ভূমিকা থাকেই। নৈতিকতা বিনির্মাণে আমরা মনে হয় আজকাল সবখানেই ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, ক্রমশ আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হবার পথে এগিয়ে যাচ্ছি, অথচ ধারাবাহিকভাবে আমাদের নৈতিকতার অবনতি ঘটছে। তবে কি দেশ হিসেবে আগামীতে আমাদের অবস্থা হবে বড়লোকের বখাটে সন্তানের মত?

কবি নজরুল ইসলাম পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর, তার অর্ধেকের কৃতিত্ব দিয়েছেন নারীকে।

আজকের বাস্তবতায়, সামান্য একজন কবি হিসেবে, ভাই হিসেবে, বাবা হিসেবে আমার তো মনে হয়, চমৎকার একটি পৃথিবী নির্মাণে অর্ধেক নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি কৃতিত্ব একজন নারীর প্রাপ্য। মা আছেন বলেই সমস্ত প্রতিকূলতা শেষেও মনে হয় পৃথিবীটা আজো এত মমতাময়, বোন আছে বলেই মনে হয়, পৃথিবীতে এখনো নির্ভরতার জায়গাগুলো শেষ হয়ে যায়নি, কন্যা আছে বলেই পৃথিবী এখনো প্রতিশ্রুতিময় এবং প্রেমিকা-স্ত্রী আছে বলেই পৃথিবী এতটা স্বপ্নময়।

পৃথিবীতে নারীরা আছে বলেই বেঁচে থাকাটা আজো এত সুন্দর, অর্থবহ। এহেন নারীর মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় যদি আমরা সবাই ব্যর্থ হই, যদি তাকে তাঁর প্রাপ্য সন্মানটুকু না দিতে পারি, আগামীর পৃথিবী আমাদের ক্ষমা করবে না।

ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনারত, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।