মহান আল্লাহ তায়ালার অপূর্ব সৃষ্টি আদম-হাওয়া। তারই ধারাবাহিকতায় এই বিশ্বমন্ডলে সৃষ্টি হয়েছেন হযরত বিবি ফাতেমা (রা.), বিবি আয়েশা (রা.), বিবি খাদিজা (রা.), হযরত রাবেয়া বসরি ও মা হালিমা (রা.)-সহ অনেক মহিয়সী ধার্মিক নারী।
বাংলাদেশের রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান। বাঙালি লেখিকা ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়া প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার শ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে বেগম রোকেয়া ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও স্বাবলম্বী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
নারী সমাজের মধ্যে বিরাজমান সব প্রকার বিভ্রান্তি ও আশঙ্কা দূর করে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যেকে সামনে রেখে প্রতি বছর দেশব্যাপী ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালন হয়েছে ২৫ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলার নারী মুক্তি আন্দোলন তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ব্রিটিশ শাসকরা (১৮৫৭-১৯৪৭) এদেশের শাসনের নামে প্রায় দুইশ বছর শোষণ করেছে। এই সময় নারী পুরুষ সবাই ছিল অধিকারবঞ্চিত। নারীর অধিকার আদায়ে কিংবা ক্ষমতায়নে তখন সমাজ ছিল সোচ্চার। তারই ধারাবাহিকতায় আজ তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়নে যা দরকার- দক্ষতা, সুস্থতা, সচেতনতা, সম্পদের মালিকানা প্রাপ্তি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্তি, জ্ঞান, নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ। এই লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ে নারীকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আছে নারীর ক্ষমতায়ন, একটি বাড়ি একটি খামার, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগ বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষা। এছাড়া বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতা, ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ড, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, কৃষি সহায়তা ট্যাক্সসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে।
তৃণমূলে অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে নারীর জনপ্রিতিনিধি রাখার বিধানটিও প্রশংসনীয়। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার আইনে সাধারণ আসনে নারীর প্রার্থী হওয়ার অধিকার অক্ষুন্ন রেখে প্রতি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখার মধ্য দিয়ে তৃণমূলে নারী ক্ষমতায়নের সুযোগ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে নারী এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে মাত্র পাঁচজন নারী সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতেন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি আসন নারীর জন্য। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব ও ডেপুটি গভর্নর পদে নারী আছেন। সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদেও আছেন নারী। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউপি সদস্য ও উপজেলা পর্যায়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদের সদস্যসহ বিভিন্ন পদে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নারী প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
নারীরা পুরুষের পাশাপাশি প্রশাসন, শিক্ষা, আইন, প্রকৌশল, চিকিৎসা, গণমাধ্যম, ব্যাংকিং, চাকরি, ব্যবসা ও নারী উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের বাংলাদেশে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়তে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের সচেতন নারীরাও অংশ নিয়েছে সাহসিকতার সঙ্গে।
আমার চোখে দেখা বোয়ালখালী উপজেলার সাবেক ইউএনও দিলসাদ বেগম, আফিয়া খাতুন ও আছিয়া খাতুন অদ্যবদি সচিব, যুগ্মসচিব ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। তাছাড়া ট্টগ্রামের বর্তমান জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ও বোয়ালখালী উপজেলার ইউএনও হিমাদ্রী খীসা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমা, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোনিয়া শফি ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সালমা ইসলামসহ দেশের জেলা ও উপজেলাগুলোতে নারীরা সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান নারীর ক্ষমতায়নে যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। এ দেশকে আরও উন্নতি ও অগ্রগতি করতে নারীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন মনে করি।
সরকার অর্থনীতি, শিক্ষা ও চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীদের জয়িতা পুরস্কারের বিধান রেখে কাজ করে যাচ্ছে।
তাই তো জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে বলতে হয়, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।
আসুন আমরা সবার প্রচেষ্টায় দেশমাতৃকার উন্নয়নে কাজ করি এবং বেগম রোকেয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে নারীর ক্ষমতায়নে ঐক্যবদ্ধ হয়।
লেখিকা
জয়িতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ও সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান, আমুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম
বাংলাদেশ সময়: ১৮১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৪