ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

এ দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সর্বনাশ করল কে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৫
এ দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সর্বনাশ করল কে?

আমি জানি এই মুহূর্তে দেশের মানুষ এই প্রশ্নের উত্তরে খালেদা জিয়ার নাম বলবে। দেশের মানুষকে দোষ দেওয়া যাবে না।

কারণ টানা হরতালের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের। যারা কট্টর বিএনপি বা জামায়াতপন্থি তারা অবশ্য গলার রগ ফুলিয়ে বলবেন, সব দোষ এই সরকারের। এই সরকার যদি গোয়ার্তুমি না করতো তাহলে তো পেট্রোলবোমা ফাটাতে হতো না, হরতাল ডাকতে হতো না।

রাজনীতির মাঠের ব্যাপারগুলো অমি মোটেও বুঝি না। মান্না-খোকার টেলিফোন আলাপ প্রকাশ হওয়ার পর বলা যেতে পারে আমি রাজনীতি খানিকটা বুঝতে পেরেছি। মাঠের রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের কী ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না এবং আপাত‍ত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে যেটাকে খুবই খারাপ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়, মাঠের রাজনীতিতে সেটা থাকলে হয়তো খুবই ভালো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।   

এই যে আমরা ভাবছি, দিনের পর দিন হরতাল ডেকে দেশের যাবতীয় সর্বনাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে বিএনপির ধীরে ধীরে সবার মন বিষিয়ে দিচ্ছে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সেটা হয়তো শুধু আমাদের ধারণা। বিএনপির নেতা নেত্রীরা হয়তো জানেন এটা আসলে ঊনসত্তুরের গণ আন্দোলনের মতো বিশাল সফল মহান একটি আন্দোলন। কাজেই এসব ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই, দর্শক হিসেবে পুরো ব্যাপারটা দেখা ছাড়া আর কিছু করারও নেই।

কোনো কিছু বলার ও করার না থাকলেও কিছু কিছু বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল না দেওয়ার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অনেক অনুনয় বিনয় করেছেন। বলা যেতে পারে অক্ষরিক অর্থে শুধু পা ধরতে বাকি রেখেছেন। কিন্তু বিএনপির (এবং তাদের সঙ্গে থাকা অন্যদলগুলোর) মন গলেনি। দিনের পর দিন হরতাল ডাকা হয়েছে এবং একটা পর একটা পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে, পিছিয়ে দিতে হয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ কিশোর-কিশোরী, তাদের ৩০ লাখ মা-বাবা এবং কোটি খানেক আপনজন গত দুই মাস নিয়মিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেদের ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়েছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় একই সময়ে ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা তারিখ পড়েছিল এবং তখন কিন্তু তাদের পরীক্ষার জন্য অবরোধে ছাড় দেওয়া হয়েছিল!

আমার প্রশ্নটি খুবই সহজ। যারা ‘ও’ লেভেল (কিংবা ‘এ’ লেভেল) পরীক্ষা দিচ্ছে তারাও বাংলাদেশের ছেলেমেয়ে। বিএনপি তাদের জন্য যদি ছাড় দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের অন্য ছেলেমেয়েদের জন্য কেনো ছাড় দেওয়া হবে না? বরং বলা যেতে পারে যারা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সংখ্যায় তারা অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে এই দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা, মফস্বল আর গ্রামের ছেলেমেয়েরা।

আমি ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। বিষয়টি হয়তো বোঝার জন্য খুবই সহজ, কিন্তু গ্রহণ করার জন্য খুবই কঠিন।

এই দেশ যারা চালায় এবং অচল করে রাখে দুই দলের কর্তাব্যক্তিরাই আসলে উচ্চবিত্তের মানুষ। তাদের ছেলেমেয়েরা সম্ভবত এসএসসি পরীক্ষা দেয় না, তারা সম্ভবত ইংরেজি মিডিয়ামে ‘এ’ লেভেল, ‘ও’ লেভেলে পড়ে। কাজেই দেশ যদিওবা গোল্লায় যায়, অন্তত নিজেদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষটা যেন ঠিকমতো দেওয়া যায় সেজন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু আমি যেটুক জানি তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরাও প্রায় সমানভাবে ভুগছে। যা‌ইহোক, এটুকু ছিল আমার ভূমিকা। এবার আসল বক্তব্যে আসি।

২.
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেভাবে দেশের লেখাপড়াকে আক্ষরিক অর্থে পঙ্গু করার সংগ্রামে নেমেছেন সেটাকে তাদের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র পেট্রোলবোমা আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করা যায়। (যারা বিএনপি রাজনীতি সমর্থন করেন তারা সম্ভবত আমার এককভাবে একজনের নাম উল্লেখ করায় একটু বিরক্ত হচ্ছেন, কারণ কাগজে কলমে এটি বিশটি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিদ্ধা‍ন্ত। কিন্তু আমরা সবাই জানি যদিও পুরো আন্দোলনটি করা হচ্ছে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু এই দলগুলোতে গণতন্ত্রের ‘গ’ কেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবকিছুই একজনের সিদ্ধান্ত। সেজন্য আমিও একজনের নাম লিখেছি। )

পেট্রোলবোমা যেরকম খুব দ্রুত একজনকে ধরাশায়ী করে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিতে পারে, ঠিকভাবে পোড়াতে পারলে আক্রান্ত মানুষ খুব কষ্ট পেয়ে মারা যায় এবং যদি কোনোভাবে বেঁচে যায় তাহলে সারাজীবনের জন্য যেরকম সারা জীবনের জন্য একটা ক্ষতচিহ্ন বহন করতে হয়। হরতাল অবরোধ দিয়ে লেখাপড়াকে আক্রমণ করাটাও অনেকটা সেরকম।

সপ্তাহের পাঁচদিন স্কুল কলেজে না গিয়ে মাত্র দু’দিনে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করলে খুব দ্রুত সেই একই রকম ক্ষত হয়। যদিবা শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা পাস করেও ফেলে এই দীর্ঘ দুই মাসের ক্ষতিটুকু কিন্তু তাদের সারাজীবন বহন করতে হবে।

তবে আমি আজকে লেখাপড়ার উপর এই নিষ্ঠুর আক্রমণের কথা বলার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে বসিনি। আমি সবার অগোচরে খুব ধীরে ধীরে লেখাপড়ার উপর যে ‘স্লো পয়জনিং’ হচ্ছে তার কথা বলতে বসেছি। তবে মূল বক্তব্যের আগে আমাকে পুরনো ইতিহাস বলতে হবে।

সেই যখন থেকে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষক হয়েছি তখন থেকে আমি জানি একজন ছেলে বা মেয়ে কী শিখছে তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার শেখার আগ্রহ আছে কি না? শেখার ক্ষমতা আছে কিনা সেই বিষয়টি। এই দেশের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আমার দুঃখের সীমা ছিল না। লেখাপড়ার নামে তাদের কিছু জিনিস মুখস্থ করানো হতো, পরীক্ষার হলে গিয়ে সেটা তাদের উগরে দিতে হতো। পড়াশোনার পুরো বিষয়টি ছিল খুব কষ্টের, কারণ মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে বোঝার জন্যে, জানার জন্যে কিংবা বিশ্লেষণ করার জন্যে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মনে রাখার বিষয়টা মানুষের থেকে ভালো পারে শিম্পাঞ্জিরা!

তাই প্রথম যখন সৃজনশীল পদ্ধতির পরীক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছিল আম‍ার আনন্দের সীমা ছিল না। (তখন অবশ্য সেটাকে বলা হতো কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন পদ্ধতি, কিন্তু কাঠামোবদ্ধ নামটাকে কেমন যেন কটমটে মনে হয়েছিল বলে এর নামটাকে পাল্টে সৃজনশীল করে দেয়া হয়েছিল) যাইহোক সৃজনশীল প্রশ্নের মূল বিষয়টা ছিল খুবই সহজ, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে আর কখনো ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু মুখস্ত করতে হবে না। তারা যদি পুরো বইটা মন দিয়ে পড়ে তাহলেই হবে, প্রশ্নগুলোর উত্তর তারা ভেবে ভেবে দিতে পারবে। নতুন কিছু শুরু করা খুবই কঠিন, এখানেও সেটা দেখা গেল। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শুরু করা মাত্রই অভিভাবকেরা এর পিছনে লেগে গেলেন। স্বার্থপর অভিভাবকদের একটি মাত্র কথা, ‘স্বীকার করি এটা খুবই ভালো পদ্ধতি, কিন্তু আমার ছেলে কিংবা মেয়ে আগের পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাক তারপর এই পদ্ধতি প্রবর্তন করা হোক!’

তারা সৃজনশীল পদ্ধতির বিরুদ্ধে রীতিমতো আন্দোলন শুরু করেছিলেন! আম‍ার মনে আছে আমরা যারা ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্থ করার যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করার এই সুযোগটা পেয়ে লুফে নিয়েছিলাম তারা সবাই মিলে সেটাকে রক্ষা করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলাম। রীতিমতো যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা যে পদ্ধতিতে (Bloom’s Taxonomy) লেখাপড়া করে, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও সেই পদ্ধতিতে লেখাপড়া করার এবং পরীক্ষা দেওয়ার একটা সুযোগ পেল। অন্যদের কথা জানি না আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আপেক্ষা করতে থাকলাম কখন এই ছেলেমেয়েগুলোকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিজের ছাত্রছাত্রী হিসেবে পাব। কারণ এই ছাত্রগুলোর মস্তিষ্কগুলো থাকবে সতেজ, তীক্ষ্ণ এবং সৃজনশীল, মুখস্থ করিয়ে করিয়ে সেগুলোকে ভোঁতা করিয়ে দেওয়া হবে না।

কিছু দিনের ভেতরে আমি প্রথম দুঃসংবাদটি পেলাম- সেটি হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্নের গাইড বই বের হয়ে গেছে। খবরটি ছিল আমর কাছে অবিশ্বাস্য, কারণ সৃজনশীল প্রশ্নটাই করা হয়েছে যেন ছাত্র-ছাত্রীদের আর প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে না হয় সেজন্যে। তার থেকেও আরো ভায়াবহ ব্যাপার ঘটতে থাকল, শুধু যে বাজারে গাইড বই বের হতে থাকল তা নয়, আমাদের দেশের বড় বড় পত্রিকাগুলোও ‘শিক্ষা পাতা’ বা এ ধরনের নাম দিয়ে তাদের পত্রিকায় গাইড বই ছাপাতে শুরু করল! এগুলো হচ্ছে সেই পত্রিকা যারা এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।

দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো সংগ্রাম করে, পত্রিকায় মূল কাজ সংবাদ ছাপানোর পাশাপাশি তারা জ্ঞান-বিজ্ঞ‍ান-আর্ট-কালচার নিয়ে ঠেলাঠেলি করে দেশেকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে জান কোরবান করে দেয়! আমার খুব ইচ্ছে এসব পত্রিকার ‘মহান’ সম্পাদকদের সঙ্গে কোনোদিন মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করি তারা কেমন করে এই দেশের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এতো বড় প্রতারণা করেন? (আমার মনে আছে আমি কোনো একটি লেখায় এই ধরনের একট‍া পত্রিকার গাইডবইয়ের উদাহারণটি তুলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি গাইড বই ছাপানো বেআইনী হয় তাহলে পত্রিকায় গাইড বই ছাপানো কেন বেআইনী হবে না? আমরা কেন এই পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারব না?)

যাই হোক, বাজারে এবং দৈনিক পত্রিকায় গাইড বই বের হওয়ার পর থেকে অনেক শিক্ষকই স্কুলের পরীক্ষায় এই গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিতে শুরু করলেন। সেই সব শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, এক সময় শুধু পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘মুখস্থ’ করলেই চলতো, এখন তাদের তার সঙ্গে সঙ্গে পুরো গাইড বইয়ের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করা শুরু করতে হলো। আমি পড়লাম মহাবিপদে, এই দেশের ছেলে-মেয়েদের অনেকেই জানে আমি এই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি যেন শুরু হতে পারে তার জন্যে অনেক চেঁচামেচি করেছি, তারা সরাসরি আমাকে অভিযোগ করতে শ‍ুরু করল। আমি তখন তাদের বুঝিয়ে বলতাম যদি দুই নম্বরী শিক্ষক হয় তাহলে সৃজনশীল গাইড বই পড়ে হয়তো স্কুলের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়‍া সম্ভব হতে পারে।

কিন্তু পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি কিংবা এইচএসসির প্রশ্নগুলো কখনোই কোনো গাইড বই থেকে আসবে না। পরীক্ষার আগে এই প্রশ্নগুলো প্রথমবার তৈরি করা হবে, কাজেই যারা গাইড বই মুখস্থ করবে সত্যিকারের পরীক্ষায় তাদের কোনোই লাভ হবে না। বরং উল্টো ব্যাপার ঘটবে, মুখস্থ করে করে পরীক্ষা দেওয়ার কারণে তারা আসল পরীক্ষাগুলোতে নিজে নিজে ভাবনা চিন্তা করে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাবে।

এতো ছিল আমি ছাত্র-ছাত্রীদের এভাবে বুঝিয়ে এসেছি এবং তারাও আমার যুক্তি মেনে নিয়েছে। এই বছর হঠাৎ করে আমি প্রথমবার সত্যিকারের বিপদে পড়েছি। আমার কাছে একজন এসএসসির বাংলা প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছে, সেই প্রশ্নে গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দে‍য়া আছে। প্রমাণ হিসেবে সে গাইড বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোও ফটোকপি করে দিয়েছে। ২০১৪ সালে যখন এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে শুরু করল তখন কিছুতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করতে রাজি হয়নি যে ব্যাপারটি আসালেই ঘটেছে। আমি এবারে এসএসসির প্রশ্ন ও গাইড বইয়ের প্রশ্ন পাশাপাশি দিয়ে দিচ্ছি, পাঠকেরা নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। শুধু এই দু’টি নয়, আরো অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে, লেখার শেষে আমি লিংক দিয়ে দিচ্ছি, যার ইচ্ছে ডাউনলোড করে সেগুলো নিজের চোখে দেখে নিতে পারবেন।

এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো ব্যাপার কী কেউ কল্পনা করতে পারবে? যারা গাইড বই ছাপায় আনন্দে তাদের বগল বাজানোর শব্দ কী সবাই শুনতে পাচ্ছেন? সেই শব্দ কী শিক্ষাবোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছাবে? এই গাইড বই বিক্রেতারা কী এখন খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশনে বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না? সেখানে তারা ঘোষণা করবে, ‘আমাদের গাইড বই বাজারের সেরা, এখান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন বেছে নেয়া হয়!’

যত স্বপ্ন ও আশা নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু করা হয়েছিল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার (নাকি দুর্নীতি?) কারণে এখন কী পুরো বিষয়টা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? শিক্ষা বোর্ডের কাছে নিশ্চয়ই রেকর্ড রয়েছে । তারা খুব ভালোভাবে জানেন কারা এই প্রশ্ন করছে, আমরা কী আশা করতে পারি না, যেসব প্রশ্নকর্তা এই দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর লেখাপড়ার পুরোপুরি সর্বনাশ করে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন আর কখনোই এরকম ঘটনা না ঘটে তার একটি গ্যারান্টি দেবেন? কারা প্রশ্নফাঁস করছে তাদের কখনো ধর‍া যায়নি, কিন্তু কারা গাইড বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন করেন তাদের ধরতে তো কোনো সমস্যা নেই! মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে জোড় হাত করে খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ করেছিলেন এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল না দিতে, আমি ঠিক একইভাবে জোড় হাত করে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব এসএসসি পরীক্ষায় গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে না দিতে।

গাইড বই থেকে তুলে দেয়া প্রশ্ন দিয়ে তৈরি করা এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের পাশাপাশি ভিন্ন আরো একটি প্রশ্নপত্র আমার হাতে এসেছে। এই প্রশ্নটি জাতীয় কারিকুলামে ইংরেজি মাধ্যমের পদার্থ বিভাগের প্রশ্নপত্র। প্রশ্নপত্রটির খানিকটা অংশ আমি এই লেখার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। জানি না সেটা পত্রিকায় দেখানো সম্ভব হবে কী না। লেখার শেষে আমি এটারও লিংক দিয়ে দিচ্ছি যে কেউ সেটা ডাউনলোড করে পুরোটা দেখে নিতে পারবেন।

এসএসসি পরীক্ষায় গাইড বই থেকে নেয়া প্রশ্ন দেখে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা পদার্থ বিজ্ঞানের এই প্রশ্নটি দেখে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গিয়েছে। একটা এতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষার এই নমুনা দেখেও আমার বিশ্বাস হতে চায় না, কেমন করে শিক্ষাবোর্ড ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে এই প্রশ্ন তুলে দিল? প্রত্যেকটি প্রশ্ন ভুল ইংরেজিতে লেখা, ছোটখাটো ভুল নয়, উৎকট ভুল।

যেমন, Who is invented air pump? How many power of an electric fan? Which mirror use of solar oven? ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশ্নটি দেখেই বোঝা যায় এটি আসলে চরম হেলা ফেলার একট‍া উদাহারণ। ইংরেজি কারিকুলামের প্রশ্ন করার জন্যে শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে পারে এরকম একজন শিক্ষক এই দেশে নেই, তা হতে পারে না। এর অর্থ যারা এর দায়িত্বে আছেন তাদের লজ্জা শরম বলে কিছু নেই- আমরা যারা এটা দেখি তারা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না, যারা এই কাজটি করেন তারা একটুও লজ্জা পান না, বরং বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান।

লেখার শুরুতে বলেছিলাম খালেদা জিয়া তার দল বল নিয়ে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছেন সেটা পুষিয়ে নেয়া যাবে কী না আমরা জানি না।

সেই সঙ্গে আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, খালেদা জিয়‍ার মতো রাতারাতি সর্বনাশ না করলেও খুব ধীরে ধীরে এই দেশের শিক্ষার সর্বনাশ করার কাজটি কিন্তু করে যাচ্ছে যাদের উপর আমরা এই দেশের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব দিয়েছি, তারাই!

আবার হাত জোড় করে বলছি, বাঁচান! আমাদের ছেলে-মেয়েদের সর্বনাশ থেকে বাঁচান।

প্রশ্নের লিংক দুটো দেখতে ক্লিক করুন:

https://dl.dropboxusercontent.com/u/105569537/guide.pdf

https://dl.dropboxusercontent.com/u/105569537/eng.pdf

বাংলাদেশ সময়: ০০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।