পৃথিবীর যেসব দেশ স্বাধীনতার পরও লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছে, হানাহানি ও রক্তক্ষয় দেখেছে শুধু রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসংগতি ও আর্থিক দুর্নীতির কারণে, তাদের তালিকা করলে বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে থাকবে বলে মনে হয় না।
এত ভালো ভালো ন্যাচারাল রিসোর্স, ফ্রেশ ওয়াটার রিসার্ভ, নদীনালা, উন্নত মাটি, সাগর-পাহাড় থাকার পরও আমরা কেন জানি দারিদ্র্যের কুয়াশায় আচ্ছন্ন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তন আজ সময়ের দাবি। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আইন ও ন্যায়বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ যেমন ক্ষতিকর, তেমনি আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিহীনতাও বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে শুরু করে স্বাধীন তদন্ত সংস্থা—সবই আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
আমাদের রাষ্ট্রের সার্বিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ঘাটতি।
একটা জাতীয় ঐক্যের মুহূর্ত দরকার, যা এরই মধ্যে দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু খুব বেশি দেরি হলে এই চেতনা, এই ঐক্য, এই দেশকে নিয়ে ভাবার স্পৃহা নষ্ট হয়ে যাবে।
আমরা যে বাংলাদেশ চাই
আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে কোনো নেতা দরিদ্রদের ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের উচ্চবিত্ত জীবনের আয়োজন করবেন না।
এমন একটি দেশ চাই, যেখানে জনপ্রতিনিধিরা দেশের মাটিতে চিকিৎসা নেবেন এবং নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যৎও এই দেশেই বিনির্মাণ করবেন। এমন একটি দেশ চাই, যেখানে মেধাপাচার বন্ধ হবে এবং দেশের উন্নয়নে সবার ভূমিকা থাকবে।
সংবিধান সংস্কার
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলের অগণতান্ত্রিক চরিত্র। গত ৫৩ বছরে কোনো শীর্ষ নেতা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। এই বাস্তবতায় গণতন্ত্রের আশা করা অবাস্তব।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই মূল চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন সংস্কার
১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. নির্বাচন কমিশনারের পদসংখ্যা বাড়িয়ে ন্যূনতম ১৫-তে উন্নীত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ বিরোধী দলগুলো কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি থেকে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার ক্রাইটেরিয়া সেট করা যেতে পারে। কোন দল কাদের মনোনীত করেছে সেটা জনস্বার্থে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত হবেন।
৩. নির্বাচনকালে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন বাধ্যতামূলক করতে হবে। পোলিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য সেনাবাহিনীর বিশেষ মনিটরিং সেল রাখতে হবে।
৪. প্রার্থীদের আয়ের উৎস ও আয়ের পরিমাণ জনস্বার্থে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
৫. নির্বাচনের ন্যূনতম দুই মাস আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেবে এবং নির্বাচনের এক মাস পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
আরো কিছু সংস্কার, যা কাম্য
১. যেকোনো সরকার চার বছরের বেশি নয়।
২. প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি নয়।
৩. পৃথক স্বাধীন পুলিশ কমিশন।
৪. সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়ের পরিপূর্ণ হস্তক্ষেপবিহীন।
৫. সম্পূর্ণ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
৬ . সম্পূর্ণ স্বাধীন দুদক (অথবা নতুন কিছু), যা সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রশাসনের কর্মকর্তার সমন্বয়ে হবে। এই কমিশন একাধারে তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রয়োজন মোতাবেক আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করতে পারবে। এই কমিশন রিপোর্ট করবে জুডিশিয়াল কাউন্সিলে। সরকারি, বেসরকারি, জনপ্রতিনিধি কিংবা যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অজ্ঞাত থেকে অভিযোগ করার জন্য হেল্পলাইন সুবিধা থাকতে হবে এবং তার প্রতিক্রিয়া গতিশীল করার জন্য আলাদা সেল থাকবে।
৭. সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন, ট্রান্সফার, ওএসডি সুপারিশ করার জন্য পৃথক স্বাধীন কমিশন গঠন। মন্ত্রণালয় কোনো মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে এই কমিশনের সুপারিশ ছাড়া ট্রান্সফার করতে পারবে না। এই কমিশন পৃথক জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তদারকিতে থাকবে।
৮. মাঠ প্রশাসনের পৃথক স্বাধীন কমিশন। প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যতটা সম্ভব মিনিমাইজ করা।
নতুন দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন নতুন এক দিগন্তের সূচনা করতে পারে। এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে জনগণের স্বপ্ন আর রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকবে না। একটি উন্নত, নৈতিক এবং মানবিক বাংলাদেশই হতে পারে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)