‘আমার অধিকার নাই, আমার জমিজমা নাই। দরিদ্র মানুষ, ভিক্ষা করে খাই।
ঘটনাটি সংঘটিত হয় ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঠিক পরের দিন।
দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে দেশের আপামর জনতার মধ্যে একটা ইতিবাচক সর্বজনীন নাগরিক প্রত্যাশা থাকে, যেন নতুন বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছি। এই নতুন বাংলাদেশ আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিহিত থাকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে সব নাগরিকের সমতা ও ন্যায্যতা। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনেও দেশের নাগরিকের মধ্যে নিঃসন্দেহে এমন আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে, যেটা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরেও আমরা দেখতে পাই।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা গণ-অভ্যুত্থান এবং বিভিন্ন স্বৈরাচারী সরকারের পতন, তার পরও দেশের নাগরিকদের ঐতিহাসিক সেই আকাঙ্ক্ষার পূরণ হয়ে ওঠে না কেন, যার কারণে কয়েক দশক অন্তর অন্তর আমরা স্বৈরাচারী শাসনের কালো গহ্বরে পতিত হই? আবার গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়? সরকার পরিবর্তনে প্রতিবারই আশা-প্রত্যাশা করে থাকি, এবার বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য হয়ে উঠবে। একজন সাধারণ নাগরিকের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিরন্তর অস্পষ্ট থেকে যায় দেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ন্যায্যতা ও অধিকারের কথা।
স্বাধীনতার পরে বিগত পাঁচ দশকে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি প্রান্তিক পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যে গতিতে মূলধারায় উঠে আসার কথা, তারা সেভাবে আসতে পারেনি। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তাদের কাঙ্ক্ষিত সেই অবস্থানে আসার মতো আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন পর্যন্ত তৈরি করে দিতে পারেনি।
এবারের জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও আমরা একই পথে হাঁটছি কি না তা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর রাষ্ট্রীয় নানা কাঠামোতে সংস্কারের লক্ষ্যে এরই মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে একটিতেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব আমরা দেখতে পাইনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের পঞ্চাশের অধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তার ভূমি অধিকার, ভাষা-সংস্কৃতি, তাদের জাতিগত পরিচয় এখনো বাংলাদেশের সংবিধানে স্থান পায়নি। যে ভূমিকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন পরিবেষ্টিত হয়, সেই ভূমি অধিকারের নিশ্চয়তা সংবিধানে নেই। যে ভাষা ও সংস্কৃতি তার পরিচয় এনে দেয়, সেটা তাদের সংবিধান স্বীকার করতে চায় না, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় কী হতে পারে।
একটি দেশের সংবিধানের তখনই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যখন বিদ্যমান কাঠামো গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। এ জন্য সাংবিধানিক সংস্কারে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় আনা আমাদের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা দিতে পারে। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে পারে না। আগামীর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অংশগ্রহণ ও তাদের ন্যায্যতার প্রতিফলন হয় সেটা নতুন সরকারের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
সংবিধান সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠলে সাবেক সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ (এমএন) লারমার কথা এসে যায়, যিনি ১৯৭২ সালের সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয় এমন সাংবিধানিক ব্যবস্থা দাবি করেছিলেন। তিনি কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর থেকে নারী-পুরুষ সবার ন্যায্য অধিকারের কথা বলেছিলেন এবং সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিও করেন। আজকের বাংলাদেশের যে সাংবিধানিক সংকট, তা তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা নিরূপণের সময় নানা অসংগতি ও অপূর্ণতাকেই ইঙ্গিত করে। প্রশ্ন উত্থাপন করা দরকার যে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রে কী ব্যবস্থা করা আছে, তাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির জন্য আইনগত পদক্ষেপ কেমন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তাদের কেমন? এগুলোর যথাযথ ও ইতিবাচক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মনে রাখতে হবে, বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা এখনো গণমানুষের হয়ে ওঠেনি।
স্বাধীনতার পরে যতগুলো সরকার ক্ষমতায় এসেছে, প্রতিটিতে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার ঊহ্য থেকেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহাসিক বঞ্চনার কথা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এখনো কতটুকু গুরুত্ব পায়, সেটা প্রশ্নের বিষয়।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা তাত্ত্বিকভাবে সব নাগরিকের জন্য সমান হলেও বাস্তবিক অর্থে এখানে জাতিগত, ধর্মীয়, লৈঙ্গিক ও শ্রেণিগত বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যেমন সংস্কার আনতে হবে, একইভাবে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সমান ব্যবস্থা রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা সেই বাংলাদেশ দেখতে চাই, যে বাংলাদেশে সাঁওতাল মায়ের আর্তনাদ শুনতে হবে না, যে বাংলাদেশে পাহাড়ি আদিবাসীদের ভূমিহারা হতে হবে না।
লেখক: তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়