দিনাজপুর: দিনাজপুর জেলার ইতিহাসে ৬ জানুয়ারি এক বেদনাবিধুর দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয় ১৯৭২ সালের এ দিনে।
দিবসটি উপলক্ষে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ, মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল ও দিনাজপুর প্রেসক্লাব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনের পর দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ির মহারাজা হাই স্কুলে স্থাপন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেতন হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙালবাড়ি ক্যাম্পের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে সমবেত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮ শতাধিক। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে শত্রুদের পুঁতে রাখা মাইনমুক্ত করতে সমবেত বীর মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করছিলেন। ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুঁতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধারকৃত মাইন ও অস্ত্রাদি জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে।
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারী সন্ধ্যায় এ রুটিন ওয়ার্কের এক পর্যায়ে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। উদ্ধারকৃত অস্ত্র বাংকারে নামানোর সময় অসতর্ক মুহূর্তে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন পড়ে যায়। এতে করে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংকারের পুরো অস্ত্রভান্ডার বিস্ফোরিত হয়। ভয়াবহ ও বিকট বিস্ফোরণে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয় মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণসহ এর আশপাশের এলাকায়। এতে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় আহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সে দিন মাইন বিস্ফোরণে কতজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। তবে সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার পূর্বে ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সাড়ে ৪শ মুক্তিযোদ্ধা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনিসহ ক্যাম্পে অবস্থানরত অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাত-পা, মাথা অনেক দূরে ছিটকে যায়। দুর্ঘটনার পর পরই শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেন্ট ভিসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্যে থেকে পরে ২৯ জন মারা যায়।
দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু জানান, ঘটনার সময় তিনি তার শহরের বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। দুর্ঘটনার পর শহরের সর্বস্তরের মানুষ ঘটনাস্থলে গিয়ে জীবিত ও মৃত্যুদের উদ্ধার করে। যারা আহত ছিল তাদেরকে চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সে সময় হাসপাতালের পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও ঔষধপত্র না থাকায় ঠিকমত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
তিনি জানান, সে দিনের ওই মাইন বিস্ফোরণে শুধু মুক্তিযোদ্ধাই নয়, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শহরের উত্তরবালুবাড়ী কুমার পাড়া মহল্লায় আরো ১৫ জন অধিবাসীও মৃত্যুবরণ করেন। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় মহারাজা স্কুলের দ্বিতল ভবনসহ আশেপাশের অধিকাংশ ঘরবাড়ি, দালানকোঠা।
তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার পরদিন ৭ জানুয়ারি দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে শহীদদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে সামরিক মর্যাদায় ১২৫ জন শহীদের মরদেহ দাফন করা হয় ঐতিহাসিক চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে। এরপর চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে আরও দাফন করা হয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করা ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ। নিহতদের মধ্যে সে সময় ৫৮ জনের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। পরে পর্যায়ক্রমে পাওয়া যায় আরও ৬৪ শহীদদের নাম ও পরিচয়। দিনাজপুরবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে জনসভায় ৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রাজেডিস্থলে শহীদদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আজহারুল আজাদ জুয়েল জানান, দিবসটি যথাযথ পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জানুয়ারি সকাল ৯টায় স্মৃতি পরিষদের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণ দিনাজপুর প্রেসক্লাবে সমবেত হয়ে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য রওনা হবেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও শপথবাক্য পাঠ শেষে মহারাজা স্কুলের উদ্দেশে রওনা হবেন এবং স্কুল প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহিদ স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা অর্পণ করবেন। বাদ আসর মহারাজা স্কুল মসজিদে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মুক্তি কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৬, ২০২৫
জেএইচ