ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং উত্তরণের পথ

সরিৎ চৌধুরী, শিক্ষার্থী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং উত্তরণের পথ

জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীজুড়ে একটা অবশ্যম্ভাবী সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশে এর প্রভাব যেভাবে দৃশ্যমান, তা অত্যন্ত ভয়াবহ।

প্রতিবছর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষত বাংলাদেশ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য পরিচিত, তা এখন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে।

প্রকৃতির শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক। খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর বাসিন্দাদের জীবনে লবণাক্ততা, বৃষ্টির অভাব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে চাষের ওপর।

খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ৩০ শতাংশ জমি এখন চাষের অনুপযোগী। কারণ পানি উপচে এসে লবণাক্ত হয়ে গেছে, যা কৃষির জন্য বিপর্যয়কর। একইভাবে ২০০৭ সালের সিডর ঘূর্ণিঝড়ের পর ২০০৯ সালের আইলার ভয়াবহতায় একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, যা ধান, পাট, গম, ভুট্টা এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিপর্যস্ত করে তুলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষত পটুয়াখালী ও বরগুনা অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য ফসল চাষ কঠিন করে দিয়েছে।

এ ছাড়া মানুষের স্বাস্থ্যও জলবায়ু পরিবর্তনের অজানা বিপদে আক্রান্ত। গরমের তীব্রতা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা এবং পানির সংক্রমণজনিত রোগগুলো দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টি করছে। ২০১৯-২০ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপকভাবে বেড়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন এর একটি বড় কারণ। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মশার বংশবিস্তার বেড়েছে।
কিন্তু এই সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষ এরই মধ্যে কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, বাঁধ এবং নদীভাঙন রোধে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষভাবে পটুয়াখালী অঞ্চলে ২০১৫ সালে নির্মিত ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের ফলে এই অঞ্চলের প্রায় এক লাখ মানুষ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। সাইক্লোন শেল্টার ও নিরাপত্তাব্যবস্থাগুলো আরো কার্যকর করা গেলে মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরো কার্যকর পদক্ষেপের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং উন্নত দেশগুলোর উচিত দুর্বল অর্থনীতি এবং জলবায়ু সংকটে ভুগতে থাকা দেশগুলোকে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সেমিনারে বাংলাদেশ বারবার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি দেশের তরুণদের মধ্যে জলবায়ু সচেতনতা তৈরির জন্য সরকার বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আগামী দিনের নেতৃত্ব তাদের হাতেই।

বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয়ের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সম্ভব। দেশের শহর ও গ্রাম উভয় পর্যায়েই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শূন্য প্লাস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত করতে হবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য গবেষণা কার্যক্রম এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও পরিবহন খাতে জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা আরো উন্নত করতে হবে, যা ভবিষ্যতে এই খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা তৈরি করবে। বাংলাদেশ যদি এমন সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে এটি শুধু দেশের জনগণের জন্য নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্যও একটি অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের মানুষ চিরকালই সংগ্রামী। আমরা যদি একত্রিত হয়ে একে অপরকে সহায়তা করি এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন কাজে লাগাতে পারি, তাহলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করতে সক্ষম হব। এভাবেই বাংলাদেশ একটি নতুন ইতিহাস রচনা করবে, যা পৃথিবীজুড়ে প্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবে।

লেখক: সরিৎ চৌধুরী, শিক্ষার্থী, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতিসংঘের ইউএনএফসিসিসির আন্তর্জাতিক ক্লাইমেট সায়েন্স অলিম্পিয়াডের সেমিফাইনালিস্ট।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।