ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

আমার প্রত্যাবর্তনের গল্প

মারিয়া কনসিসাও | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২১
আমার প্রত্যাবর্তনের গল্প

এটাকে আমি প্রত্যাবর্তন চ্যালেঞ্জ বলব; এটা এমন একটি যাত্রা, যা শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল। যেখানে এক বছর আগে আমি অনুভব করেছি—আমার কিছুই নেই, আমি কিছুই অর্জন করতে পারব না।

আমার মনে হয়েছিল—আমার বেশির ভাগ শক্তি আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, নিজের জন্য বা অন্য যারা আমার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল তাদের জন্য আমার আর কিছুই করার নেই।

আমার লক্ষ্য ক্যাসকায়েসে ২৩ অক্টোবর, ২০২১ এর পূর্ণ আয়রনম্যান ইভেন্ট এবং পরদিন ২৪ অক্টোবর অর্ধেক আয়রনম্যান ইভেন্ট সম্পন্ন করা। এ দুটি অফিসিয়াল আয়রনম্যান ইভেন্ট। ৩.৮ কিমি সাঁতার, ১৮০ কিমি সাইক্লিং এবং ৪২.২ কিমি সম্পূর্ণ ম্যারাথন দৌড় নিয়ে গঠিত একটি পূর্ণ আয়রনম্যান ইভেন্ট। অর্ধেক আয়রনম্যান ইভেন্টেও একই কার্যকলাপ, তবে প্রতিটির দূরত্ব অর্ধেক।

এক বছর আগে আমার হাঁটুর একটি জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ২০১৮ সালে মাউন্ট ডেনালিতে আমার শেষ পর্বতারোহণ প্রচেষ্টায় হাঁটুতে গুরুতর আঘাত পাই। বরফের ওপর আছড়ে পড়ায় আমার পেটেলা, তরুণাস্থি ও ফিমার হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যা পরবর্তী দুই বছরে দ্রুত অবনতি হয়। অস্ত্রোপচার ছাড়া আমার আর কোনো উপায়ই ছিল না। দীর্ঘমেয়াদে হাঁটু রক্ষায় নিজের জেদ উপেক্ষা করে অন্যের পরামর্শ মানতে হয়েছিল আমাকে। তবে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল, কেননা হাঁটতে অক্ষম জেনেই আমাকে জেগে উঠতে হবে, শক্তি ফিরে পেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। আমি নিরুপায় বোধ করেছিলাম, নিজের হাঁটু বাঁচাতে আমি ৭ নভেম্বর, ২০২০ অস্ত্রোপচার করতে এগিয়ে গেলাম।

তবে অস্ত্রোপচার নিয়ে আমার অনুভূতি ইতিবাচক ছিল। অস্ত্রোপচারের পর ব্যথাটা দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠলো, আমি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম এবং অনেকগুলো সপ্তাহ ক্রাচে ভর দিয়ে কাটালাম। এসব অভিজ্ঞতা আমার কল্পনার চেয়েও বাজে ছিল। অস্ত্রোপচারের আগে যে ইতিবাচক বোধ ছিল, তা অস্ত্রোপচারের পর দ্রুতই অদৃশ্য হয়ে যায়! এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আমার মানসিক শক্তি নষ্ট করে দেয়। আমার মনে হয়েছিল, আবার হাঁটতে পারা অসম্ভব। আমি আক্ষরিক অর্থে আমার পেশীগুলির অবনতি দেখতে পাচ্ছিলাম এবং অনুভব করছিলাম—আমি আমার পায়ে শারীরিক শক্তি হারাচ্ছি। প্রথম ফিজিওথেরাপি সেশনে আমি অকেজো ছিলাম, আমি আমার পা সামান্যই নাড়াতে পারতাম।

এসব আমার মানসিক শক্তিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে। আমি অনুভব করতে শুরু করি যে, আমি কখনোই আর আগের মতো হতে পারব না এবং কোনো অ্যাথলেটিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না। বেশকিছু ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি সেশনগুলি ভালো করার পরিবর্তে আরও খারাপ লাগতে শুরু করে, আমার শরীর হাল ছেড়ে দেয়, আমার পা সিদ্ধান্ত নেয়—আমি আর কখনও সম্পূর্ণ নড়াচড়া করব না।

তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—আমাকে একটি চ্যালেঞ্জ সেট করতে হবে। এমন একটা কিছু যা গড় ব্যক্তির চিন্তার চেয়ে বড়, যাতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি। তবে সেটা এত বড়ও নয় যে, তা স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে।


বাংলাদেশি শিশুদের সঙ্গে মারিয়া কনসিসাও

পর্তুগালে সপ্তাহান্তের আয়রনম্যান ট্রায়াথলনগুলি আমার জন্য যথেষ্ট ছিল, এমনকি একটি রেস সম্পূর্ণ করাই যথেষ্ট অথবা অর্ধেক আয়রনম্যান বা পূর্ণ আয়রনম্যান ইভেন্ট সম্পন্ন করা। তাই নিজের ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষায় পরপর দুদিন দুটি রেস করতে নিজেকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দিতে থাকি।

আমি লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। আমি জানতাম যে, এমনকি উভয় দৌড় সম্পূর্ণ করার কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য, নিজের পুনর্বাসন ও পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন এবং ফিটনেস ফিরে পেতে আমাকে যে কাজটি করতে হবে তা ছিল অপরিসীম। আমাকে প্রতিদিন ক্রমাগত উন্নতি করতে হবে। প্রায়ই আমি অসম্ভব ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়তাম, কিন্তু আমাকে চালিয়ে যেতে হয়েছিল প্রতিদিন কিছু অগ্রগতি আমার জন্য অপরিহার্য ছিল, তা সামান্য হলেও। সময় ঘনিয়ে আসে, রেসের মাত্র কয়েক দিন বাকি থাকতে আমি শক্তিশালী বোধ করতে থাকি। তখনও আমি দৌড়াতে পারি না।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক সময়ের মধ্যে নিজেকে তৈরি করা। সেইসঙ্গে প্রথম দিনে ১৬ ঘণ্টার রেস সম্পূর্ণ করার জন্য শক্তি অর্জন ও তা ধরে রাখা এবং তারপরে কার্যত কোনো পুনরুদ্ধারের সময় ছাড়াই পরের দিন আবার রেসে অংশ নেওয়া। আমি তখনও পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসিনি, তবে আমাকে কেবল প্রার্থনা করতে হবে যে, আমি চ্যালেঞ্জটি সম্পূর্ণ করতে যথেষ্ট তৈরি হয়েছি। যদি আমার কাছে এই চ্যালেঞ্জ না থাকতো, আমি সম্ভবত এখনও হাঁটাহাঁটি করায় ভুগতাম। আমার জন্য এটি ছিল একটি সুযোগ, যা আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

তবে এটি মোটেও সম্ভব হতো না বেশ কয়েকজন লোকের সাহায্য ছাড়া—যুক্তরাজ্যের তুখোড় হাঁটু সার্জন ডা. আলি বাজওয়া, পুনর্বাসনের জন্য বিশেষত দুবাইয়ের আপ অ্যান্ড রানিং ক্লিনিকের ডা. আনা, শক্তি অর্জনের জন্য বিআর পারফরম্যান্সের কোচ জোয়াও আর্তেচে, সুইমসমুথ দুবাইয়ের পাওলো এবং আমার ভার্চ্যুয়াল কোচ বেন বারউইক। তারা কেবল প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলিই সরবরাহ করেননি—তারা আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন, যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই আমি বাংলাদেশের সংগ্রামী পরিবারগুলোকে, বিশেষত একক মা ও তাদের মেয়েদের সাহায্য করে যাচ্ছি। তাদেরও সুযোগগুলো খুঁজে পেতে এবং তা গ্রহণ করতে সহযোগিতা প্রয়োজন, তাদেরও প্রয়োজন তাদের ওপর লোকেদের আস্থা রাখা ও তাদের নিজেদের ওপর নিজের ভরসা ফিরে পাওয়া।

আমি ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে একশোরও বেশি পরিবার এবং ছয়শোরও বেশি শিশুকে সহযোগিতা করছি। পারিবারিক সহায়তা ও শিক্ষাদান করছি। এখন সারা বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্র রয়েছে, যারা স্নাতক সম্পন্ন করেছে বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য অধ্যয়ন করছে। আমি সম্প্রতি ৫টি একক মা পরিবার এবং তাদের ৯ জন অল্পবয়সী কন্যাকে দুবাইতে পুনর্বাসনের জন্য একটি নতুন প্রকল্প শুরু করেছি। সেই মায়েদের জন্য উপযুক্ত কাজ খুঁজে বের করতে চাইছি, যাতে তারা তাদের মেয়েদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে সহায়তা করতে পারে। যদি তারা বাংলাদেশে থাকে তবে এই সুযোগগুলো পাবে না। তাই তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এটা তাদের স্বাধীন ও শক্তিশালী করে তোলে।

মারিয়া কনসিকাও: একজন পর্তুগিজ মানবহিতৈষী। তিনি বাংলাদেশের বস্তিতে বসবাসরত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকেন। ২০১৬ সালে জিকিউ ম্যাগাজিনের পর্তুগিজ সংস্করণ তাকে উইমেন অব দ্য ইয়ার সম্মাননায় ভূষিত করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২১
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।