ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৮)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩২ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৮) ঝিনাইদহের রাস্তা

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশাভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানেতার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৩৮
মাগুরা-ঝিনাইদহ-সরোজগঞ্জ (চুয়াডাঙ্গা)= ৫৪.৪৭ কিমি

কাল রাত থেকে কানে বাজছিল আবু নাসির বাবলু চাচার কথাগুলো। মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন ওনার মাগুরা থেকে ভারতের বনগাঁ যাওয়ার সেই গল্প শুনেছিলাম গত রাতে।

ঘোর বর্ষা হয়েছিল নাকি সেবার। হাঁটু পানি, কোমর পানি ডিঙিয়ে যাওয়ার সময়সামনে পড়েছে অর্ধগলিত লাশ। লাঠি দিয়ে মরদেহ সরিয়ে সামনে এগিয়েছেন তখন। সেতুলনায় আমি যে পথটা হাঁটছি তা কিছুই নয়।

কালের বিবর্তনে দারুণ সব রাস্তাহয়েছে এখন। দিনের পর দিন হাঁটার কষ্টটা বাদে আর খুব বেশি কষ্ট পেতে হয় এমনকিছুই নেই। এসব ভাবতে ভাবতে পথে নামতেই প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া একদল লোকেরসামনে পড়ে গেলাম। সব জেলাতেই প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া লোকেদের দেখেই দিনেরশুরুটা হচ্ছে। মহাসড়কে ওঠার আগে শহরের ভেতরের রাস্তা ধরেই কিছুটা পথএগোলাম। নতুন বাজারের কাছেই পড়ল কালী মন্দির৷ নবগঙ্গা নদী থেকে বের হওয়াশীর্ণ একটা ধারা আছে হাতের ডান পাশে। এর সবচেয়ে গভীর অংশে হাঁটু পানি।

কালী মন্দিরের পরে আরো বেশ ক'টা মন্দির। এই এলাকাতেই অনেকগুলো প্যান্ডেলদেখে বুঝলাম কোনো একটা মেলা/উৎসব হয়েছে আগেরদিন। মেলা/উৎসবের স্বাক্ষর বহনকরছেরাস্তায় পড়ে থাকা অসংখ্য প্লাস্টিকের প্যাকেট। বাটিকাডাঙ্গা পার হয়েশিবরামপুরের রাস্তায়। এ রাস্তা বেশ নির্জন। দু'ধারে ধানক্ষেত আর কলাগাছেরসমারোহ। মহাসড়কে উঠলাম ইছাখাদা বাজার হয়ে। হাজরাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরসাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মুন্সী বাবর আলীর পোস্টার দেখলাম এখানেই। সোনালি আঁশ। মহাসড়কে উঠতেই বেশকিছু লিচুবাগানে দৃষ্টি আটকালো। হাজরাপুর বাজার পার হয়েসাইত্রিশ বাজার। ক্রমানুসারে সাইত্রিশ বাজারের পরের বাজারের নাম আটত্রিশবাজার না হয়ে হলো আলমখালী বাজার। এখানেই এক লোক আমাকে দেখিয়ে তার পাশেরলোককে বলছে- 'আমি তো দেখেই বুঝিছি, এই লোক প্যারেড কত্তিছে!' আমি কীসেরপ্যারেড করছি, সেটা আমি নিজেই ধরতে পারলাম না। সাচানী পেরিয়ে হাটগোপালপুর। এখান থেকেই পা রাখলাম ঝিনাইদহ জেলায়।

হাটগোপালপুরের শুরুতেই বিশালএক কলার হাট। ছোট ছোট মিনি ট্রাকে ভর্তি কলা। তুমুল বেচা-কেনা চলছে। বড়-সড়এই বাজারের মাঝামাঝিতে আছে পাটের বাজারও। নসিমন টাইপ ভ্যানে বোঝাই হয়েএসেছে এই সোনালী আঁশ। কালা বাজারের পর কিছু স্থানে লাগানো হয়েছে সরিষা। সবুজ কাণ্ডে হলুদ ফুল সবে আসতে শুরু করেছে৷ এখনি রঙের আবেশ ছড়াচ্ছে। এসবদেখতে দেখতেই গোয়ালপাড়া বাজার। আজকের মহাসড়কটা দারুণ ছায়া সুনিবিড়।

কড়ইগাছগুলোর ডাল-পালা মাথার উপর ছড়িয়ে আছে শিরা-উপশিরার মতো। বেশ ক'টা সুদৃশ্যভবন নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কাষ্টসাগরাবাজারের কাছে মাঝবয়সী এক নারী হঠাৎ থামতে বললেন। হাতে ধরে রাখা পাত্রেনানান রঙের কাপড়। ইশারা দিয়ে পাশের দোকানের বেঞ্চিতে বসতে বললেন। একে দেখেইধান্দাবাজ মনে হওয়ায় আমি আরেকটু জোরে হাঁটা ধরলাম বাজারের দিকে। পেছন থেকে মহিলা ক্রমাগত বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছে থামার জন্য। শেষমেষ হাঁটায়না পেরে টমটমে উঠে আমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় শাসিয়ে গেলো আঙুল উঁচিয়ে। বিপদ পুরোপুরি না কাটলেও এই ঝামেলা দূর হওয়াতে হাঁফ ছাড়লাম।

ধানহাড়িয়া বাজার পার হয়েই ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। বাস টার্মিনালআসতেই পেয়ে গেলাম তিনমুখী রাস্তা। হাতের বামের রাস্তা এগিয়েছে যশোর পানে। কুষ্টিয়াগামী হয়েছে ডান দিকের রাস্তা। ঝিনাইদহ শহর হয়ে চুয়াডাঙ্গা নিয়েযাবে আমাদের মাঝের রাস্তাটা। অল্প এগিয়েই নবগঙ্গা নদীর উপরের সেতু পার হতেইদেখছিলাম পাশেই নির্মাণাধীন নতুন সেতু। পানির ট্যাংক হয়ে শহরের ডাকঘরেরমোড়র সুইট হোটেলেই অপেক্ষা করছিল আমার মেডিক্যাল কলেজেরই বন্ধু সাজু। কতদিনপর দেখা ওর সাথে। ঝিনাইদহতেই বাড়ি ওর।

সঙ্গে ওর পরিচিত হাফিজ ভাই। তিনি কাজ করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে। সাজুকে পেয়ে গল্পের ঝাঁপিখুললাম দু’জনেই। খুলনার চুকনগরের আব্বাসের হোটেলে চুই ঝাল খাওয়ার ইচ্ছে আগেথেকেই পোষণ করে রেখেছিলাম। ঝিনাইদহেই চুই ঝাল খাওয়ার সুযোগ মিলবে কে জানতো। সুইট হোটেলের চুই ঝাল দিয়ে রান্না করা খাসিটা খুবই সুস্বাদু ছিল। সঙ্গে গরমমিষ্টি দিয়ে আহার পর্ব সাঙ্গ করে হাঁটা শুরু করতেই সাজু জানালো ও কিছুদূরহাঁটবে। পায়রা চত্বরসাজু ওর নিজের শহরের নানান জিনিসের সঙ্গে পরিচয় করিয়েদিচ্ছে আমাকে। ওড়ার জন্য অপেক্ষামাণ পায়রা চত্বর পেরিয়ে সরকারি কে সি কলেজ। মাঝখানে ডিভাইডার দেওয়া বড় সড়কটার নাম অগ্নিবীণা সড়ক। কি দারুণ নাম একটাসড়কের। মুজিব চত্বর পার হতেই দু’পাশে বিশাল সব কড়ই গাছ। এদের বেড় এতই বেশিযে পাশাপাশি চার-পাঁচ জন লোক হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েও এর পুরো প্রশস্ততারসঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।

খানিক পরেই বিদায় নিল সাজু। এদিকের একটা জিনিসবেশ মজার লাগলো। গম্বুজাকৃতি খড়ের গাদা দেখেই আমরা অভ্যস্ত৷ কুঁড়েঘরেরআকৃতির খড়ের গাদা বানানো হয় এদিকে। অল্প এগিয়েই জোহান ড্রিম ভ্যালী নামকবিনোদন কেন্দ্র। এই ভরদুপুরে তেমন কোনো দর্শনার্থী চোখে পড়লো না। প্রকাণ্ড সবকড়ই গাছের ছায়ায় চলতে চলতে ভাবনা এলো দেশের সব রাস্তাগুলো এমন সুশীতলছায়ার হলে মন্দ হতো না।

নগরবাথান ছাড়িয়ে আঠার মাইল নামক বাজার। এরপরেই সরকারি ভেটেরেনারি কলেজ৷ এর অবস্থান শহর থেকে বেশ দূরে৷ হলিধানীবাজারের কাছেই দুই মোটরসাইকেল আরোহী এলো সেলফি তুলতে। হাসিমুখে পোজ দিয়েখানিক বাদেই চলে এলাম হলিধানী বাজার। সাগেন্না আমেরচারা বাজার নামক বিচিত্রনামের এক বাজার পেলাম। মাঠে স্তূপ করে রাখা খড় দেখতে দেখতেই বৈডাঙ্গাবাজার। এর মধ্যেই এক টমটমওয়ালা অনেকদূর পথ টমটমের গতি আমার হাঁটার গতিরসঙ্গে মিলিয়ে এপ্রশ্নে-ওপ্রশ্নে আমাকে ব্যতিব্যস্ত রেখে সামনে এগোল। হাঁটারসময় অন্যদিন লোকে জিজ্ঞেস করে কদ্দূর যাবো। আজ অনেকেই জিজ্ঞেস করছে আমিহেঁটে ইন্ডিয়া যাব কিনা। সীমানার কাছাকাছি জেলা হলে এমনই হয়। বিশাল বেড়ের কড়ই গাছডাকবাংলা নামক বিশাল বাজার ছাড়াতেই এক টমটম থেকে নারী কণ্ঠের ডাক এলো আমাকেউদ্দেশ্য করেই। কাছে যেতেই ভদ্রমহিলা বললেন টমটমে উঠতে। উনি সেই ঝিনাইদহতেআমাকে হাঁটতে দেখেছেন। এখনো হাঁটছি দেখে উনি ধরেই নিয়েছেন পকেটে পয়সা নেইবলেই হাঁটছি। ভাড়া উনি দেবেন জানিয়ে দিয়ে টমটমে ওঠার জন্য আবার সাধাসাধিকরতেই আমার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললাম উনাকে।

নিরস্ত করতে বেশ বেগই পেতে হলো। সাধুহাটি বাজারের পর আর প্রশস্ত কড়ই নেই, তার বদলে আছে ঢ্যাঙা ইপিল ইপিলগাছ। দশ মাইল নামক জায়গায় এসে পৌঁছেছি ঠিক সন্ধ্যায়। চুয়াডাঙ্গা জেলারসীমানা শুরু এখান থেকেই। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পথ দেখে চলছি। সরোজগঞ্জপৌঁছে ইস্তফা দিলাম আজকের মতো হাঁটার। কাল শুরু করবো ঠিক এখান থেকেই। আজ আমারথাকার ব্যবস্থা দিপু ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। চুয়াডাঙা শহরের বড় বাজারেরকাছেই ওনার শ্বশুরালয়। অটোতে চেপে রওয়ানা দিয়ে খানিক বাদে বাদে কতদূর এলামতার আপডেট দিচ্ছি দিপু ভাইয়ের শ্যালক রাজ্জাক ভাইকে। বড় বাজার নামতেই ওনারবাইকে চেপে মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাড়িতে। গাছ-গাছড়াতে ভরা বাড়িটা প্রথমদর্শনেই করলো মুগ্ধ।

চলবে...

আরও পড়ুন>>

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)


বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।