ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ম্যাঙ্গো ট্যুরিজম, ঘুরে আসুন আমের দেশে

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৬
ম্যাঙ্গো ট্যুরিজম, ঘুরে আসুন আমের দেশে

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ফিরে: পূর্ণিমা আসতে আর মোটে দুই দিন বাকি। অনেকটা পূর্ণরূপ নিয়ে চাঁদ আলো দিয়ে ভরে রেখেছে রাতের আমবাগান।

চাদের আলোয় দেখা গেলো গাছে গাছে ঝুলে আছে আমগুলো। যেনো তারকারাজী নিচে নেমে এসে থোক বেঁধে একেকটি গাছের সঙ্গে মিশে রয়েছে।

বাগানে পাহারাদারদের একেকটি টঙ ঘর থেকে হারিকেনের মিটিমিটি আলো চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্য। আমবাগানে রাতের সৌন্দর্য্য এমন হতে পারে! বিষ্ময় চোখে মুখে।

বিষ্ময় দেখেই বুঝি একটি টঙের পাহারাদারদের ফিরোজ কবির হাতের টর্চ থেকে আলো ফেললেন কাছের একটি আম গাছে। তাতে থরে থরে ঝুলে থাকা আমগুলো চোখে পড়লো চাঁদের আলোর তুলনায় অনেক স্পষ্ট করে। অনেক আম নিয়ে একেকটি ছোট পাতলা ডাল ঝুঁকে পড়েছে। সুন্দরের তৃষ্ণা রয়েছে এমন ব্যক্তিমাত্রই এই সৌন্দয্যে পুলকিত হবেন।

খুব দ্রুতই বুঝতে পারলাম এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন কেনো পাঠিয়েছেন এই আমের দেশে।

প্রতিদিনের মিটিংয়ে গত বুধবার কথা হচ্ছিলো আম আর আমের মওসুম নিয়ে। তখন তিনিই প্রথম উচ্চারণ করলেন শব্দটি- ‘ম্যাঙ্গো ট্যুরিজম’। বললেন, এই সময়ে পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী এলাকায় গাছে গাছে ঝুলে থাকা আম এমন এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে যা হয় দেখার মতো। তুলে ধরতে পারলে এই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের দুই জেলা হতে পারে ভ্রমণপিয়াসীদের অন্যতম গন্তব্য।

বললাম, যেতে চাই।
এডিটর ইন চিফ বললেন, যাও।

বৃহস্পতিবার ১৯ মে রওয়ানা দিয়ে রাতে পৌঁছে ২০ ও ২১ মে দুই দিন গোটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরে ঘুরে রিপোর্ট করতে হবে। দলে দুই জন- হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন ও স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মবিনুল ইসলাম।

যেমন নির্দেশনা তেমন কাজ। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছে ঠিক সাড়ে নয়টায় নিজেদের আবিষ্কার করলাম শহরের ভেতরেই টিকরামপুরের ওই আমবাগানে। আমচাষিরা জানালেন, তাদের সুখানন্দ আর উদ্বেগের কথা। নেই মনুষ্য চোরের ভয়। তবে শেয়ালদের হানা এই সময়ে বাড়ে। গাছ থেকে পাকা আম পড়লে তা কেড়ে নিয়ে দে ছুট। সেটাও বড় বিষয় নয়। এই সময় বড় ভয় এই যে কোনওটার ডাল যদি ছিড়ে পড়ে যায় আমের ভারে।

রাতেই বাংলানিউজে প্রকাশিত হলো রিপোর্ট:


আম পাকার আগে আগে টেনশনটা প্রতিক্ষণের, সৌন্দর্যটা দেখার মতো



রাতেই বাগানটা ঘুরে দেখার লোভ সামলানো গেলো না। ছোট গাছ, মাঝারি গাছ, বড় গাছ, সবগুলোতে ঝুলছে আম। কোনো আম প্রায় মাটি সংলগ্ন, কোনোটি মাটি থেকে দুই/চার ইঞ্চি ওপরে, কোনোটি বা গাছের মগডালে।
বাহারি এসব আম, বাহারি তার নাম ফজলি, আশ্বিনা, ক্ষীরসাপাত, গোপালভোগ, মোহনভোগ, বোম্বাই, গুটি আম আরও কতো কি! আমের ভারে কোনও কোনও গাছের ডাল মাটিতে নুয়ে পড়েছে। তাতে বাঁশের ঠেকা দিয়ে ওপরে উঠিয়ে রাখা। বড় বড় আম গাছে গাছে ঝুলে থেকে সৌন্দর্য্য যেমন ছড়াচ্ছে তেমনি স্বপ্ন যোগাচ্ছে চাষীর চোখে। আর মোটেই কটা দিন। আম পাকবে। তা খাওয়া যেমন হবে, বাজারেও বিক্রি হবে। আয় হবে। গোটা এলাকা আমের গন্ধে মৌ মৌ করবে। এ নিয়েও রাতেই বাংলানিউজ প্রকাশ করে রিপোর্ট:


  গাছে আম, চাষির চোখে স্বপ্ন



শুক্রবার ভোরে বাংলানিউজ টিম চলে যায় শিবগঞ্জের পথে। রাস্তায় বের হতেই চোখে পড়তে শুরু করে আম গাছ। কোথাও একটি কোথা তিনটি-চারটি, কোথাও ডজন ডজন, কোথাও শত শত গাছ। পথের দুই ধরে একটু পর পরই আম গাছ। তাতে ঝুলে আছে আম আর আম। কোনো কোনো গাছে পাতার চেয়ে আম বেশি। কোনওটিতে আবার আম নেই। এটা অনেকেরই জানা আম গাছ এ বছর ফল দিলে পরের বছর দেয় না। সে কারণে কোনও কোনও গামে আম ছিলো না। তবে আম ফলেছে এমন গাছই বেশি যাতে ছেয়ে আছে গোটা এলাকা। শিবগঞ্জে পৌঁছে এলাকার সুপরিচিত তরুণ আমচাষী ইসমাইল হোসেন শামীমের আমবাগানে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে শতবর্ষী আমগাছ রয়েছে অনেক। যেগুলো এখনো ফল দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। এছাড়া কোনওটির বয়স ৪০-৫০ বছর কোনওটির ২০-৩০ কোনওটির ১৫-২০ বছর বয়স। ইসমাইল জানালেন এইসব বাগান তার পৈত্রিক সম্পত্তি। যা উত্তরাধিকারে পেয়েছেন। শামীম খান আরও জানালেন তারা একসময় লিজ দিয়ে আম চাষ করাতেন। কিন্তু লিজ নিয়ে অধিক মুনাফার লোভে গাছে হরমোন ব্যবহার করা হতো। আর সে কারণেই এখন নিজেরাই আম চাষ করেন।

এখানে বাগানে ঘুরে ঘুরে আরও কয়েকজন গৃহস্থের সঙ্গে দেখা হলো নিজেরাই চাষ করেছেন, নিজেরাই পরিচর্যা করছেন আমের। বাংলানিউজে রিপোর্ট হলো:


গৃহস্থ ফিরছে আম চাষে, লিজে কালটার আতঙ্ক

 


আমযাত্রা অব্যাহত থাকলো বাংলানিউজ টিমের। একটি আমবাগানের ভেতর দিয়ে মোটরবাইকে ছুটে যেতে যেতে দুই দিকে চোখে পড়লো বাহারি নামের আম। তবে রঙের বাহার এখনই নয়, এখন সব আমই সবুজ। একেবেঁকে আমের বাগানের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে দেখা গেলো ছোট বড় অনেক গাছ। বাগান যেনো শেষ হয় না। একটার পর একটা নতুন নতুন বাগান। আর যেখানে শেষ হয়েছে। সেখানেও আসলে শেষ হয়নি। দেখা গেলো নতুন এলাকায় পড়েছে ছোট ছোট আমের চারা। দিনে দিনে আরও বাড়ছে আম চাষের পরিধি। গেলো বছরেও যেখানে ধানের চাষ ছিলো এবছর সেখানেই লাগানো হয়েছে আমের চারা। পাটের চাষ হয়েছে সেখানেও লাগানো হয়েছে আমের চারা। এক-দুই বছর পর যা পুরোপুরি আমবাগানে রূপ নেবে। এনিয়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত হলো:



বাড়ছে আমবাগানের পরিধি, কমছে ধান-পাটের চাষ





ততক্ষণে আমের দেশের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ বাংলানিউজ টিম। সত্যিই যারা সুন্দরের পিয়াসী, যারা ভ্রমণে তাদের মনোরঞ্জন পছন্দ করেন। আর বাংলাদেশের ঋতু প্রকৃতিতে যারা মুগ্ধ হতে চান তাদের জন্য অত্যন্ত পছন্দের হতে পারে এইসব আমবাগানে ঘুরে ঘুরে দেখা। আমের পুরো মওসুম জুড়েই থাকে এর সৌন্দর্য। গাছে গাছে যখন মুকুল ধরে তখনকার সৌন্দর্যের কথা বলাই বাহুল্য, ফাগুনে আমের বনের ঘ্রাণের কথা জাতীয় সঙ্গীতেই রয়েছে। এরপর আগগুলো যখন গোটা গোটা হয়ে ওঠে তখন থাকে আরেক সৌন্দর্য্য। আমচাষীরা জানালেন ওই সময় গাছগুলোতে আরও অনেক আম থাকে। আর যখন আমপাকার মওসুম শুরু হয়। এই সময় গাছে গাছে যখন আম পাকতে শুরু করে তখন গোটা এলাকার সৌন্দর্যের সঙ্গে যোগ হয় সুমিষ্ট ঘ্রাণ যা আপনার প্রাণ মাতিয়ে দেবে। কেমন হতে পারে ম্যাঙ্গো ট্যুরিজম। কিভাবে যাবেন, কিভাবে ঘুরবেন কোথায় থাকবেন, কি দেখবেন সে নিয়ে বাংলানিউজ প্রকাশ করলো:




আমযজ্ঞ দেখতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ-কানসাট




চোখে পড়লো আমের বনে শিশুদের কোলাহল। ‘ঝরের দিনে মামার দেশে আম কুঁড়াতে সুখ,  সে কথা সবার জানা। ফলে এই সময়টিতে আমের দেশে যাদের মামার দেশ তারা চলে আসে, আরা যাদের নিজেদের ঘরবাড়ি তারাও মেতে থাকে আম কুঁড়ানো আনন্দে। আর আম পাকার মওসুমে দুরন্ত কৌশরের দিনগুলো হয়ে উঠে আরও উপভোগ্য। আমের বাগানে ঘুরতে ঘুরতে এমন দুরন্তদের দেখা আপনি পেয়ে যাবেন। যাদের মধ্যে সেরা স্বাদের আম কোনটি সে নিয়েও চলে মধুর ঝগড়া। এদের দেখা পেয়েছিলো বাংলানিউজও। শিশুদের সেই কোলাহলের ওপর প্রকাশিত হলো রিপোর্ট:




 শিশুরা মাত ক্ষিরসাপাতে...





বাগান ঘুরে ঘুরে আরও চোখে পড়লো কোনও কোনও গাছে আম নয়, দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট কাগজের ব্যাগ। জানা গেলো ওটা ফ্রুট ব্যাগিং। এই ব্যাগ দিয়ে আম ঢেকে রাখলে শেষ মূহূর্তের কীট-পতঙ্গের আক্রমন থেকে আমগুলোকে রক্ষা করা যায়। আর আমের রঙ হয়ে ওঠে চমৎকার। ফ্রুট ব্যাগিংয়ের মাধ্যমে রাসয়নিকমুক্ত আম উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। আর চাষীদের কেউ কেউ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পেতে শুরু করেছেন। আম দেখা না গেলেও চাষীদের কাছে এই কাগজের ব্যাগে ঢাকা আমগুলো দেখতেই বেশি ভালো লাগে। কারণ ওগুলোর কারণেই আম অসাধারণ রঙ ধরবে যা বাজারে বাজারে বাহার ছড়াবে। এনিয়েও বাংলানিউজ প্রকাশ করলো:



ফ্রুট ব্যাগিং, আমে কাঙ্খিত রঙ, উল্লসিত চাষি




আমের উৎপাদন প্রক্রিয়াটিও দেখার মতো। আমচারা কিভাবে গুটি থেকে গ্র্যাফ্টিং হয়ে একেকটি পরিণত আমগাছে রূপ নেয় সে বিষয়টি দেখতে বাংলানিউজ টিম যায় শিবগঞ্জ-কানসাটে মূলসড়ক থেকে নেমে তিন কিলোমিটার ভেতরে শাহবাজপুর ইউনিয়নের ধোবরাবাড়ির একটি বড় আম বাগান ঘেঁষে আম গাছের বড় নার্সারিতে। সেখানে তরুণ উদ্যোক্তা মাসুদ রানার নার্সারিটি দেখার মতো। তিনি নিজেই দেখান কিভাবে গুটি থেকে গ্র্যাফ্টিং করে আমের চারা বাড়িয়ে তোলেন। যা নিয়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত হয় রিপোর্ট:



 গুটি থেকে গ্র্যাফ্টিং (ভিডিওসহ)




এর বাইরে অারও নানা বিষয় চোখে পড়ে। সামনে আসে আম নিয়ে আরও নানা কিছু যা প্রতিবেদনের চোখ এড়ায় না। সেগুলোও বাদ যায়নি। ফলে প্রকাশিত হলো-

বাগানের আম ফরমালিনমুক্ত
আমের চারায় ভাগ্য গড়ে কোটিপতি
উচ্চ ফলনশীলে হারিয়ে যাচ্ছে বাহারি সব নাম
ঝরা আমে আমচুর, নারীর শ্রমে কোটি টাকার অর্থনীতি
যে উপজেলার ৯০ ভাগ মানুষই ‘আম অর্থনীতি’ নির্ভর

এমন আরও কিছু ছোটবড় খবর। সব মিলিয়ে এই ছিলো বাংলানিউজের ম্যাঙ্গো ট্যুরিজমের আয়োজন।
আমের সৌন্দর্য দেখতে হলে এখনই বেরিয়ে পড়ুন। এই সপ্তাহান্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে পারে আপনার গন্তব্য। আরেকটা কথা বলে রাখি দিন পনেরোর মধ্যে আম গাছ সব ফাঁকা হয়ে যাবে। তখন কিন্তু আর দেখার তেমন কিছু থাকবে না। অপেক্ষা করতে হবে আগামী মুকুল ধরার দিনগুলোর জন্য।

বাংলাদেশ সময় ১১৩৪ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।