[শেষ পর্ব]
প্রায় বিশ মিনিট হাঁটার পর সমতল মতো জায়গায় পৌঁছালাম। এটিই সিপ্পি সামিট।

undefined
ঘড়ির কাঁটা বলছে ১০টা ৫৩ বাজে। আমাদের কতক্ষণ লাগলো পাঠক হিসাব করে নিন। সকালের মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া এখন আর নেই। মাথার উপরে নীল আকাশ, সূর্য হাসছে। অনেক দিন আগের দেখা আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হলো। আমরা সিপ্পি আরসুয়াংয়ের চূড়ায়। চূড়া থেকে বেশি কিছু দেখার কোনো উপায় নেই। সেখানটায় পরিষ্কার করা হয়েছিলো সেখান দিয়েই দীগন্ত দেখা যাচ্ছে। সামিটের মূল আনন্দই এখানে। আপনি যখন দেখবেন সবকিছু আপনার নীচে এমনকি মেঘও ছুঁতে পারছেন, কষ্ট মনে হবে সার্থক।

undefined
এতো কষ্ট করে পাহাড় চূড়া ছুঁতে আসার রহস্য এখানে। দূরে দেখা যাচ্ছিলো শঙ্খমনি পাড়া। সিপ্পিতে আসার অনেকগুলো রাস্তা আছে। আমরা এসেছি রনিন পাড়া হয়ে। অনেকে আবার সিপ্পি পাড়া হয়েও আসতে পারেন। তবে রনিন পাড়া হয়ে আসাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। চূড়ায় বসে চললো দেদারসে ফটোসেশন। চকলেট, বিস্কুট আর পানি খেয়ে শরীরটা চাঙা করে নিলাম। দুটি ভিডিও শ্যুটও করলাম মোবাইল ক্যামেরায়।
ফিরতে পথে। আবার নামতে নাগলাম। কিন্তু আমি নিজে বেশ ধীর হয়ে পড়েছিলাম। ফলে পুরো টিমকে মাঝে মাঝে দাঁড়াতে হচ্ছিলো। পাড়ায় পৌঁছাছাম দুপুর দুইটার কিছু পরে। ক্ষুধায় প্রাণ বেরিয়ে আসার জোগাড়। গরম গরম ভাত, ডাল আর আগের দিনের মুরগির সঙ্গে পাহাড়ি জুমের ঝাল মরিচ। পাহাড়ে আসলেই শুধু এমন অমৃত মেলে। কিন্তু এমন মজার খাবার খেয়েও কি জিরোনোর কোনো ফুরসত আছে। আমাদের আজকেই ফিরতে হবে। শাফিন গো ধরেছে সে আজই ঢাকার বাস ধরবে। আপাতদৃষ্টিতে সেটি অসম্ভব।

undefined
এখন তিনটে বাজে। রোয়াংছড়ি সদরে পৌঁছাতে সাত সাড়ে সাত ঘণ্টা লাগবে। কিছুই করার নেই। সিপ্পি সামিটের ধকল সওয়া শরীর নিয়ে ব্যাকপ্যাক চাপিয়ে আবার পথে নামলাম। ততক্ষণে কারবারির পরিবারের সবার সঙ্গে দারুণ সখ্য হয়ে গেছে। আর কয়েকদিন পরেই ছিলো বড়দিন। পাড়ায় উৎসবের আবহ। ঐশ্বর্যময় এ উদার প্রকৃতির কোলে এ গ্রাম থেকে বিদায় নিতে হলো অসাধারণ কিছু মানুষদের কাছ থেকে। অবশ্যই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

undefined
ফেরার পথে পাইক্ষং পাড়া অবধি পৌঁছাতে সন্ধ্যা নামলো। এ পাহাড়ি পথে সম্বল শুধু একটি টর্চ। তবে আশার কথা আকাশে চাঁদ আছে। পূর্ণিমা আরও কয়েকদিন পর। কিন্তু এই আধখানা চাঁদই বিরান পাহাড়ের কোলে যে আলো ছড়ালো তা তুলনাহীন। নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় চাঁদের আলোয় টর্চ নিভিয়ে পথ চলছি শুধু আমরা তিনটি মানুষ। দূরের এক পাড়া থেকে ভেসে এলো ঢোলের আওয়াজ। আহা! জীবন মাঝে মধ্যে এতো সুন্দর হয়ে ওঠে। মনে হয় জীবনে দুঃখ বলে কিছু নেই। আমি বারবার পিছিয়ে পড়ছিলাম। পলাশ দা তা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে ছাড়লেন না। কিন্তু পথ চলা তো আর থামাইনি। ধীরে ধীরে রোয়াংছড়ির দূরত্ব কমতে লাগলো।

undefined
এভাবে আমরা যখন রোয়াংছড়ি সদরে এসে পৌঁছালাম তখন রাত সাড়ে নয়টা। পাহাড়ি জনপদ তখন ঘুম বিভোর। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিলো। পুরো বাজারে একটিমাত্র খাবার হোটেলে আলো জ্বলছিলো। তারা দোকান বন্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। খাবার আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে বললেন নেই, তবে ব্যবস্থা করা যাবে।
ব্যবস্থাটি হলো হোটেল কর্মচারীদের জন্য খাবার আছে সেটি আমরা খাবো। পরে তারা আবার রান্না করবেন। পাহাড়ি এই সরল মানুষগুলো নির্দ্বিধায় নিজেদের খাবার আমাদের দিয়ে দিলেন। আমরা গোগ্রাসে গিলছি। খাওয়ার পর আর উঠতে পারি না চেয়ার থেকে। আজ দিনে হিসাব করে দেখলাম মোট ষোল ঘণ্টা হেঁটেছি। কল্পনা করুন কোনো সরল সমতল রাস্তা না, বাইতে হয়েছে কঠিন সব চড়াই উৎরাই।

undefined
রোয়াছড়ি সদরে একটিই থাকার হোটেল। তাতে জায়গা পাওয়া গেলো। এরপরের গল্প চিরচেনা আর দশটা অভিযান থেকে ফেরার পর যা হয় আর কি। পলাশ দা বিদায় নিলেন। আমরা টিভিতে বেয়ার গ্রিলস শো দেখতে দেখতে ঘুমের দেশে। সকালে উঠে প্রথম বাস ধরেই বান্দরবান শহরে এসে তাজিংডং হোটেলের অমৃতসম নাস্তা। এরপর অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকার বাসও পেয়ে গেলাম। বিদায় জানাতে হলো আমাদের কাছে ‘পৃথিবীর রাজধানী’ বান্দরবানকে। আবারও ফিরবো এটি জানা কথা। তবে এরপরের ফেরাটা হবে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে। জানিয়ে দিলাম আগে ভাগেই, হুম!
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৬
এএ/