ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩২, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১২ (ভিডিও সহ)

তাজমহল ও কালোতাজ: প্রেমের অপ্রেমের

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
তাজমহল ও কালোতাজ: প্রেমের অপ্রেমের ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

তাজমহল। একটি নাম, একটি বিস্ময়।

ভালোবাসার এক অপূর্ব নির্দশন। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজের সমাধির ওপর নির্মাণ করেন তাজমহল।

মৃত্যুই মানুষের শেষ নয়। মৃত্যুর পরও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, বাঁচিয়ে রাখতে চায় তার প্রিয় মানুষকে। মমতাজ বেঁচে ছিলেন শাহজাহানের হৃদয়ে।

মমতাজমহল বেঁচে থাকতে তিলে তিলে শাহজাহানের হৃদয়ে গড়েছিলেন এক প্রেমের সৌধ। তাইতো মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে ছিলেন সেখানেই। ভালোবাসা এভাবেই বেঁচে থাকে যুগে যুগে। ভালোবাসাই ভালোবাসার জীবন।

undefined



মমতাজের ভালোবাসা শাহজাহান হৃদয়ে বেঁচে ছিল অতৃপ্ত প্রেমের প্রতিভূ হয়ে। সে ভালোবাসা অমর করে রাখতেই তাজের সৃষ্টি। প্রেম যে অস্তিত্বহীন কোনো অলীক কল্পনা নয়, চির জাগরুক এক সত্ত্বা-তাজমহলেই তার প্রকাশ।

তাইতো এতো শত বছর পরেও তাজমহল আজো প্রেমের মিনার। শাহজাহান-মমতাজের ভালোবাসার আকাশ ছাড়িয়ে তা এখন বিশ্বমানবের ভালোবাসার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মানব হৃদয়ে প্রেমের আলো ছড়িয়ে দেবে তা হাজার বছর পরেও।   

undefined



তাজমহল তো কেবল শ্বেত মর্মর পাথরের স্মৃতিসৌধ নয়। এর সব কিছুই অনন্য-অসাধারণ।

দেখতে যদিও হুমায়ুনের সমাধি কিংবা আরো কয়েকটি মুঘল স্থাপনার মতো। কিন্তু তা বাহ্যিক স্থাপনায় মাত্র। বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য কিংবা গুণবিচারে নয়। এর বাইরের প্রাচীর হয়তো অন্যান্য মুঘল প্রাচীরের মতো। কিন্তু তার মাঝেও সার্বিক সৌন্দর্য বিচারে তাজমহল অনন্য। এর সার্বিক সৌন্দর্যে পারস্য, তুর্কি, ভারতীয় ও ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে যা আর কোনো স্থাপত্যে দেখা যায়না।  

undefined



আগ্রা দূর্গ, হুমায়ুনের সমাধি, রেডফোর্ট কিংবা আমাদের লালবাগের কেল্লা-সর্বত্রই একই মুঘল স্থাপত্যরীতি লক্ষ্য করি। তবে রীতি এক হলেও এর মাঝেও ভিন্নতা ছাপ স্পষ্ট। বাগান, পানির ফোয়ারা, মিনার, প্রাচীরের মাঝে দেখা যায় এ ভিন্নতা।

মুঘলরা বাগান ভালোবাসতেন। অন্যান্য মুঘল স্থাপনায় অবশ্য চারদিকেই বাগান। বসরা অথবা পারস্যের গোলাপ আরো কত শত ফুল। আগ্রা দুর্গেও দেখেছি শত ফুলের সমাহার। হুমায়ুনের সমাধিতেও আছে প্রশস্ত বাগান। সেই মুঘল ফুলের গাছ তো আজ আর নেই। নেই সেই তরুণ গোলাপ। আছে শুধু পরিত্যক্ত বাগান। কবির ভাষায়...
‘হারানো উদ্যানে গাঢ় মেলামেশা মনে পড়ে গেলে
দু’জনে কি কোনোদিন বেরিয়েছ নিমগ্ন ভ্রমণে
আকাশ ও ধরণীর চুম্বনের মতো কোনো স্থানে?’

undefined


মুঘলদের কাছে বাগান যেন এক টুকরো স্বর্গ। বাবর থেকে শুরু করে সবাই বাগান-সমাধিতে শায়িত হতে চেয়েছেন। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, শাহজাহানের এ রকম বাগান-সমাধি হয়েছে। বাকিদের সে ললাট লিখন হয়নি।

তাজমহলের চারদিকে নয়, তিনদিকে রয়েছে বাগান। উত্তর দিকে রয়েছে যমুনা। তিনদিকে স্বর্গের বাগান। আর অন্যদিকে স্বর্গের নদী। মাঝে স্বর্গের দিকে ধাবমান তাজের মিনার। এ যেন স্বর্গ থেকে এসে স্বর্গেই ফিরে যাওয়া।

undefined



বাগানের রয়েছে উ‍ঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা। সমাধি বরাবর দুই পাশে আছে আরো চৌবাচ্চা। যেখানে খেলা করে তাজের প্রতিফলন।

যমুনায় তাজের প্রতিফলন যেনো এক স্বর্গীয় প্রেমেরই প্রতিচ্ছবি। আর বাগানে চৌবাচ্চা বা ফোয়ারায় যে প্রতিচ্ছবি তা যেন মাটির পৃথিবীতে স্বর্গীয় প্রেমের প্রতিক।

তাজমহল সৃষ্টির পর বহুবার এর সংস্কার করা হয়েছে। অনেক কিছুই হারিয়েছে তার আদি রূপ। আকবরের মৃত্যুর পরতো এর ফটকও খুলে নেওয়া হয়েছে। মুঘল আমলেও কয়েকবার সংস্কার হয়েছে তাজ। এরপর ইংরেজরা এসেতো আরো পরিবর্তন করেছে। মুঘল বাগানের এখন ইংরেজ চেহারা। তবে তাজের মূল ভবন এখনো বহাল আছে তার মুঘল অবয়বেই।  

undefined



পিরামিড যুগে শাহেনশাহরা নিজেদের সমাধির স্থান ও স্থাপত্য নিজেরাই নির্বাচন করতেন। বিশ্বব্যাপী এরকম অনেক নজির আছে। মৃত্যুর আগে তারা সমাধি নির্মাণের কাজ শেষ করে যেতেন। অনেক সময় কাজ শেষ না হলে তাদের উত্তরাধিকারীরা সমাপ্ত করতেন সে অসমাপ্ত সমাধি। আকবরের সমাধি সমাপ্ত করেছেন সেলিম, হুমায়ুনের সমাধি স্ত্রী হামিদা বানু বেগম।

শাহজাহানও মমতাজকে ওয়াদা করেছিলেন তার সমাধির ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাজের কাজে হাত দেন শাহজাহান।

undefined



দরবারে বিদ্রোহী পুত্র আর অন্তরে স্ত্রীর ভালোবাসা। শাহজাহানের সৌভাগ্য যে তিনি ক্ষমতা হারাবার আগেই তাজমহলের কাজ প্রায় শেষ হয়ে যায়। আর নিষ্ঠুর নিয়তির হাত থেকে বেঁচে যায় তাজমহল। তাজমহল নির্মিতব্য অবস্থায় শাহজাহান ক্ষমতা হারালে হয়তো বিশ্ববাসী তাজমহলকে পেতো না।

ইতিহাস বলে, শাহজাহান কখনো জীবোদ্দশায় তাজমহলে যেতে পারেননি। কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিদ্রোহী পুত্রের হাতে বন্দি হন। জীবনের গোধুলি বেলায় আগ্রা দূর্গ থেকেই চেয়ে থেকেছেন  প্রিয়তমা স্ত্রীর সৌধ পানে।

undefined



তাজমহলতো নির্মিত হলো। কিন্তু মমতাজ বিরহে শাহজাহানের অতৃপ্ত হৃদয়তো বেদনার এক নীল স্রোতধারা-যমুনা। বিরহের মাঝেইতো প্রেমের পূর্ণতা। যমুনার একপারে যদি প্রেমের সৌধ-তাজমহল হয়, তবে আরেক পারে কেন বিরহ সৌধ নয়? তা না হলে যমুনারই বা পূর্ণতা কোথায়?

শাহজাহান যমুনার ওপারে তাই গড়তে চেয়েছেন বিরহের এক সৌধ-কালোতাজ। কিন্তু সময় যে বড় নিষ্ঠুর। বিদ্রোহী পুত্রের হাতে বন্দি বৃদ্ধ প্রেমিকের সে বাসনা অপূর্ণই থেকে গেলো। হয়তো বিরহে প্রেমের পূর্ণতা হলেও প্রেমের নিয়তি বুঝি বিরহ নয়। তাই জীবনের এপারে বিরহ থাকলেও ওপারে প্রেমই বেঁচে থাকুক! পাশাপাশি শুয়ে আসে দুই অতৃপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকা। যেন কবির ভাষায়...

‘পাথরের ঢাকনা খুলে কখনো কি পাশে এসে মমতাজ বসে কোনোদিন?
সুগন্ধী স্নানের সব পুরাতন স্মৃতিকথা বলাবলি হয় কি দুজনে?
জানি প্রতি জোৎস্নারাতে তোমার উঠোনে বড় ঘোর কলরব...’

undefined



নদীর ওপার থেকে শাহজাহান কেমন করে প্রিয়ার সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ করবেন সে পরিকল্পনাও কারিগরদের হাতে ছিল। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু কালোতাজ বা জাহানমহল আর হলো না। হয়তো দু’জন প্রেম সৌধেই সমাহিত হবেন তাজের বুকে-এই ছিল তাদের নিয়তি।

undefined



বর্ণনায় আছে, আটাশ ধরনের মহামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেল পাথরের সমাহার ঘটেছে তাজমহলে। এর সঙ্গে আছে খোদাই করা রঙিন দামি পাথর। সম্রাট নিজে এগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। স্থাপত্য নকশা ও কৌশলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

তাইতো ঋতু ও সময়ভেদে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায় তাজ। সুবেহ সাদিকে এক রঙ, সকালের প্রথম সূর্যদয়ে এক রঙ ধারণ করে তাজ। দুপুর, বিকাল, গোধুলি ও রাতে –ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় তাজমহল। ভরা পূর্ণিমায়ও যেমন উজ্জ্বল, আমাবস্যার অমানিশায়ও আলোকোজ্জ্বল এ তাজ। ফায়ার স্টোন থেকে অন্ধকারেও বের হয়ে আসে আলোর বিচ্ছুরণ। এ এক অপূর্ব দৃশ্য।

undefined



বর্ষা ও বসন্তেও তার সৌন্দর্যে এতোটুকু কমতি নেই। আকাশে সাদা মেঘের ওপরে খেলা করে তাজের ছায়া। মনে হয় যেন সাদা মেঘের মতো আকাশে ঝুলছে। এক রহস্যময় দৃশ্যপট সৃষ্টি করে ধরণীর বুকে, প্রেমিকের বুকে।  

ভালোবাসা কোনো বাদশাহী ফরমান না। মানব হৃদয়ের চিরন্তন আকুতি। আবেগ, সহানুভূতি, স্নেহ ও বিশ্বাসের সমন্বয়ে এক অদৃশ্য শক্তি। বিরহ ও দু:খের আরেক নামই প্রেম। কখনো তা বেদনার নীল আসমান, কখনো তা যমুনার বুকে এক রহস্য তরী।

ভিডিও

কবি বলেন, সত্যিকারের প্রেম যদি কিছু থাকে তবে তারই নির্যাস হলো তাজ। তাজ কি তবে পাথরের ফুল? নয় তো তার অন্তর থেকে কেন ভেসে আসে গুলাবি আতরের সুগন্ধ! যিনি প্রেমিক তিনি পাথরেই ফুল ফোটাতে পারেন। শাহজাহান পেরেছেন। তিনি যে প্রেমের কবি। চলে গেছেন সময়ের ওপারে। রয়েছে গেছে তার অমর কবিতা- তাজমহল। কবির ভাষায়...

‘বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে, মারা যেতে হয়।
এখন নিশ্বাস নিতে পারো তুমি, নির্বিঘ্ন প্রহর
পরষ্পর কথা বলো, স্পর্শ করো, ডাকো প্রিয়তমা!
সর্বান্তঃকরণ প্রেম সমস্ত ধ্বংসের পরও পৃথিবীতে ঠিক রয়ে যায়।
ঠিকমতো গাঁথা হলে ভালোবাসা স্থির শিল্পকলা’।

শেষ পর্ব

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৫
এএসআর

** তাজমহলের হৃদয় ছুঁয়ে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১০: দেয়ালেরও কান আছে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৯: শূন্য সমাধিতে পূর্ণ সিকান্দ্রা, আছেন শুধু আকবর
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৮: আগ্রা দুর্গ: অন্তরে তাজ অন্দরে কারাবাস!
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৭: আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬: দিল্লির পথে পথে

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।