ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩২, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৭

আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৫
আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস ছবি: লেখক

আগ্রা। একটি নাম।

একটি ইতিহাস। যে নামে কল্পনায় ভেসে ওঠে প্রেমের এক অনুপম নিদর্শন। পাশ দিয়ে যার বয়ে চলেছে অমর প্রেমের এক অবারিত স্রোতধারা-প্রেম যমুনা। সিন্ধুর তীর ঘেঁষে যে সভ্যতার সূচনা যমুনায় তার পরিণয়, মিলন, ব্যাপ্তি এমনকি পরিসমাপ্তিও। সেই যমুনার প্রেম স্রোতে বিধৌত একটি নগরের নাম আগ্রা।  

undefined



ইতিহাসের নির্মাতা মানুষ। কিন্তু রচয়িতা? ইতিহাস নির্মাণ হয় তার সমকালে আর রচিত হয় আগামীতে- হয়তো শত সহস্র বছর পরে। কিন্তু কখনো কখনো ইতিহাসের এ অমোঘ বার্তাটি পাই হাজার বছর আগেও।   

তাইতো মহাভারতেও আমরা আগ্রাকে খুঁজে পাই অগ্রবন নামে। আলেকজান্ডারের জীবনীকার টলেমির লেখায়ও খুঁজে পাই এ আগ্রাকে। আগ্রার ললাটে রাজটিকা হয়তো পরিয়েছে মুঘলরা কিন্তু তার ললাট লিখন তো সাঙ্গ হয়েছে মহাভারতেরই।

undefined



আজকের যে আগ্রা তার পত্তন হয় ১৫০৪ সালে সিকান্দার লোদির হাতে। কিন্তু আগ্রা লোদি বংশের নয়। মুঘল খানদানের। তাই খুব বেশি দিন যায়নি। মাত্র দুই দশকেই বাবরের হাতে শোভা পেয়েছে আগ্রার নিশান। এরপর আগ্রাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যমুনার নীল স্রোতের মতোই অভিজাত তার রক্তপ্রবাহ। সাড়ে তিনশ’ বছরের আভিজাত্যের চাদরে মোড়া এক নগর হয়েছে আগ্রা। হয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী।

আগ্রাতো কেবল তাজমহলের শহর নয়। মুঘল পরিবারের পদভারে প্রকম্পিত এক নগর। তাজমহল থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে আগ্রার দুর্গই ছিল মুঘলদের অন্দর মহল।

undefined



বাবর থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের সাড়ে তিনশ’ বছরের ইতিহাস বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকা এক দুর্গের নাম আগ্রা ফোর্ট। এর প্রতিটি ইট কাঠ লাল বেলে পাথর যেনো ইতিহাসের একেকটি সাক্ষী। এ দুর্গের দেওয়ালে, প্রাসাদের কোণে, খাস মহলে এমনকি বাগানে কান পেতে শুনুন, উপলব্ধি করুন হারানো সেই ইতিহাস।    

হৃদয়ে তাজমহল নিয়ে দিল্লি থেকে আগ্রার পথে যাত্রা শুরু করি। দিল্লি ভারতের রাজধানী। কিন্তু আগ্রা ইতিহাসের রাজধানী। এর প্রতিটি প্রান্তেই যেনো ইতিহাসের আনাগোনা। সেই আগ্রার পথে বিশাখা পট্টম একপ্রেসে প্রায় তিন ঘণ্টার ভ্রমণ। ট্রেনটা বেশ সকাল সকাল। তাই নিজামুদ্দিন স্টেশনেই ট্রাডিশনাল ইন্ডিয়ান ব্রেকফাস্ট।

undefined



হুমায়ুনের সমাধির পাশ দিয়ে সমান্তরাল রেললাইন বয়ে চললো শাহজাহান-মমতাজ মহালের সমাধির পানে।

সবুজের বুক চিরে এগিয়ে চললো ট্রেন। সহযাত্রী আরো কত মানুষ। নানা বর্ণের, পোশাকের, গড়ন ও গঠনের, আকারের, প্রকৃতির। বৈচিত্র্য তাদের ভাষায়, উচ্চারণে, ভঙ্গিতে, ভালোবাসায় এমনকি ঘৃণায়। কিন্তু ভিন্নতা পেলাম না শিশুর হাসি-কান্নায় আর মাতৃস্নেহে।  
 

undefined



কম্পার্টমেন্টে দেখা এক বৃদ্ধ দম্পতির সাথে। বয়স সত্তরের কোঠায়। বিশাখা পট্টম যাচ্ছেন নাতিদের দেখতে। ভালোবাসার টান বুঝি এমনই হয়- জলস্রোতের মতোই তা নিম্নগামী। তাইতো এ বয়সেও রক্তের টানে সারা দিতে এ দীর্ঘ যাত্রা।  

পথে যেতে পথে আরও কত কথা। বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলতেই কিছুক্ষণ চুপ। ট্রেনের জানালায় বাইরে তাকিয়ে বললেন, সব পলিটিশিয়ানদের বদমায়েশি বুঝলে। কত বড় মুল্লুক ছিল...ক্ষমতার জন্যই এতো ভাগাভাগি।

undefined



জানালার বাইরে তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করলাম। প্রচণ্ড রোদে ঘর্মাক্ত কৃষক, ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, মুটে-মজুর আরও কতো মানুষ। সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলমান একই ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাম্রাজ্য, প্রেম, দুঃখ ও বেদনার দুই উত্তরাধিকারী। ব্যবধান শুধু একগুচ্ছ কাঁটাতারের। তবে কি র‍্যাডক্লিফের মানচিত্র ভালোবাসার চেয়েও শক্তিশালী? গঙ্গার পবিত্র জল কি পদ্মায় এসে অচ্ছুত হয়ে গেছে নাকি যমুনার প্রেম সুধা ব্রহ্মপুত্রে এসে গরলসুধায় রূপান্তর হয়েছে?
 

undefined



এলোমেলো আরো কত ভাবনায় ডুবে ছিলাম। ১২টার দিকে আগ্রা পৌঁছুলাম। হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মুঘলদের ঘর বসতি আগ্রা ফোর্টের উদ্দেশে।

এই সেই আগ্রা দুর্গ যেখানে সব মুঘল সম্রাট ও তাদের পরিবারের ছিল বসবাস-আনাগোনা। যেখান থেকে শাসন করা হতো পুরো ভারতবর্ষ যা বিস্তৃত ছিল বাংলা, আফগান, লাহোর ছাড়িয়ে আরও প্রসারিত।

undefined



এখান থেকেই আকবর তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন। শাসন করেছেন জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেবসহ আরও সব রাজাধিরাজ।

চারদিকে কয়েক স্তরের উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা পুরো দুর্গ। তার বাইরে দিয়ে চারদিকেই রয়েছে গভীর খাদ। অধিকতর নিরাপত্তার জন্যই এ গভীর খাদ। পানি থাকতো এ খাদে। সাঁতার কাটতো কুমিরও।

undefined



অপ্রতিরোধ্য ও অজেয় এক দুর্গ। শত্রুপক্ষের কেউ ঢুকে পড়লেও রক্ষে নেই। প্রাচীরের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হতো। পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া সমতল ও ঢালু পথ মাড়িয়ে মুঘল দুর্গ আর জয় করা হতো না শত্রুদের।
 
কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আচ্ছাদিত আগ্রা ফোর্ট। অনেকগুলো গেট আজ আর নেই। তারপরও রয়েছে অনেক ফটক। অন্যান্য মুঘল স্থাপত্যের মতো এখানেও চারদিকে চারটি গেট আছে। ভেতরে ঢুকেই জাহাঙ্গীর মহল। এছাড়া আছে যোধাবাঈয়ের মহল, শাহজাহানের খাস মহল, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস।  

undefined



মুঘলরা বাগান ভালোবাসতো। তাই প্রত্যেক মুঘল স্থাপত্যের সাথে সুদৃশ্য বাগান অপরিহার্য। আছে শিষমহল, মসজিদ। মিনা বাজার নিয়ে মুঘলদের আছে অনেক ঘটনা। সেই মিনা বাজারও আছে দুর্গের ভেতরেই। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ নির্মান ও স্থাপত্যশৈলী।

বাবর আগ্রা জয় করেছেন। হুমায়ুনও এসেছেন আগ্রায়। তবে, দুর্গটি তৈরি হয় সম্রাট আকবরের সময়ে। আবুল ফজলের বর্ণনায় সেরকমই পাওয়া যায়।

undefined



অন্য এক বর্ণনায় আছে, আগ্রা ফোর্ট মুঘলদেরও আগে নির্মিত হয়েছে। দিল্লির প্রথম সুলতান সিকান্দার লোদি আগ্রায় এসে এই দুর্গে থাকতেন। তার পুত্র ইব্রাহিম লোদীও থেকেছেন এখানে। লোদী বংশের পরে এটি বাবরের অধিকারে আসে।

১৫৩০ সালে হুমায়ুনের রাজ্যাভিষেকও হয় এ দুর্গে। অভিষেক হয়েছে আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের।

undefined



বিভিন্ন সম্রাটদের সময় এর সংস্কার হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশরা এর ব্যাপক পরিবর্তন করে। ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যারাক নির্মাণের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় এ দুর্গে। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে অনেক ভবন। কোথাও কোথাও ক্ষয়ে গেছে এর ইট-পাথর-সুরকি।

undefined



কিন্তু তারপরও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আগ্রা ফোর্ট। ইতিহাস ও মহাকালের সাক্ষী হয়ে। হয়তোবা প্রেম অথবা অপ্রেমেরও।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
এএ

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬: দিল্লির পথে পথে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।