ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩২, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বিভীষিকাময় সুন্দরে-৮

কিশোরী জিংসিয়ামের মৃত্যুস্মৃতি বিজড়িত ‘সাইতার’

রিয়াসাদ সানভী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫
কিশোরী জিংসিয়ামের মৃত্যুস্মৃতি বিজড়িত ‘সাইতার’ ছবি: শামীমা মিতু

পূর্ব প্রকাশের পর
বান্দরবান থেকে ফিরে: সেকেন্ড স্টেপের খানিকটা দেখাও যাচ্ছে। এখান থেকে জুম খেতের ট্রেইল ধরে আরও নেমে গেলে ঝিরি পাওয়া যাবে।

যেটি অল্প একটু গিয়ে এ ঝরনার থার্ড স্টেপ হয়ে নীচে পড়ছে। জিংসিয়াম সাইতার পথের দুর্গমতার কারণে সত্যিই এলিট ঝরনা! এর দর্শন লাভ এতো সহজ না। তবে একবার দর্শন দিলে জিংসিয়াম সাইতার পুরো রূপের ডালিই খুলে দেয়।
jhorna

jhorna


আমরা টের পেয়েছিলাম একটু পর। জুমের পথ পেরিয়ে এক ঝিরিতে পড়লাম। এখান থেকে থার্ড স্টেপ নেমে গেছে। সময়ের অভাবে এর নীচ পর্যন্ত আর যেতে পারিনি। এ ঝরনার নামকরণের পেছনে রয়েছে ট্র্যাজিক এক উপখ্যান। জিংসিয়াম নামে এক ষোড়শীর অকাল মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এর নামকরণের ইতিহাস। এই থার্ড স্টেপের উপর থেকেই সে নাকি লাফিয়ে পড়েছিলো নীচে। বম ভাষায় সাইতার মানে ঝরনা।

undefined


ঝিরিতে পানির স্রোত ভয়ংকর। দাঁড়িয়ে থাকতে এখানে রীতিমতো কসরত করতে হয়। কোনো মতো বাকিটুকু পেরিয়ে দাঁড়ালাম সেকেন্ড স্টেপের সামনে। পানির গতিবেগ দেখলে ভয় পেতে হয়। দিনের প্রথমভাগে জাদিপাইকে দেখেছিলাম দূর থেকে। এর শক্তিমত্তা বুঝিনি। কিন্তু হাত ছোঁয়া দূরত্বে জিংসিয়াম সাইতারের সেকেন্ড স্টেপের জল পতনের গতি এতই ভয়ানক মনে হলো নীচে দাঁড়ালে মাথাটা ফেটে যাবে।

undefined


সে ঝুঁকি আর নিলাম না। রংধনু এখানেও তার রং চেনাচ্ছে। ক্যামেরা বের করা যাচ্ছিলো না। জাদিপাই যদি ঝরনার রানী হয় জিংসিয়াম সাইতার অবশ্যই সেনাপতি। এর  পুরো উপস্থাপনায় এক ধরনের যুদ্ধেংদেহী ভাব আছে। দেখলাম তৌহিদ দড়ির গোছা খুলছে। বললো, ফাস্ট স্টেপে যেতে এক জায়গায় দড়ি বাঁধতে হবে। বলেই বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে উঠতে লাগলো সে। আড়চোখে আর সবাইকে দেখে আমিও তাকে অনুসরণ করলাম।

undefined


কোন সন্দেহ নেই পুরো টিমকে সবচেয়ে ভয়ংকর পথটুকু পেরুতে হয়েছিলো জিংসিয়াম সাইতারের ফার্স্ট স্টেপে যেতে। ৭০, ৮০ ডিগ্রি খাঁড়া পিচ্ছিল পথের এক জায়গায় গিয়ে থেমে গেলাম। তাকিয়ে দেখি রিজ লাইন এমনই সরু যে সেখানে এ পায়েও ঠিক মতো দাঁড়ানো যাবে না। একপাশে খাঁড়া পাথরের দেয়াল অন্যদিকে গভীর খাদ। পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। তৌহিদ তরতর করে জায়গাটাতে দড়ি বেঁধে এগিয়ে গিয়ে এবার আমাকে আসতে ইশারা করলো। আমিও ঝামেলা ছাড়াই জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম।

undefined


কিন্তু চিন্তা হতে লাগলো অন্যদের জন্য। মিতু তো প্রথমে আসতেই চায়নি। তবে কোনো অঘটন ঘটলো না। সাবধানে নেমে দাঁড়ালাম জিংসিয়াম সাইতারের ফাস্ট স্টেপের সামনে। প্রচুর ঝোপ, বড় গাছ, আগাছা পড়ে আছে নীচে। ঢলের পানিতে উপর থেকে এসেছে এসব। সত্যিকারের বুনো ঝরনা এটি। এতটা কসরত করতে হবে ভাবিনি। ঝরনার বর্ণনা আর বেশি দিচ্ছি না। ভরা বর্ষায় আপনারা নিজ চোখেই দেখে যাবেন। তৌহিদকে তার স্যান্ডেল জোড়া হারাতে হয়েছে স্রোতে। আমরা যখন ফার্স্ট স্টেপে তখনই দিনের শেষ সূর্য পশ্চিম থেকে ঝিলিক মারছিলো। ফেরার কথা খেয়াল হলো। একবার অন্ধকার নেমে এলে এখান থেকে বেরোনো কোনোমতেই সম্ভব না।

undefined


আসার সময় দড়ি ধরে সে অংশটুকু পার হতে বুক ঢিব ঢিব করছিলো। এক সময় সাইতারের ভয়াবহ সৌন্দর্যকে পেছনে ফেলে সেই জুম ঘরটিতে এসে পৌঁছালাম। দিনের সূর্য তখনও কিছুটা আছে। জুম ঘরে বসে খেয়াল হলো আরে পা তো চেক করা হয়নি। যা ভেবেছিলাম তাই হলো! আঙুলের ফাঁকে বসে বাবাজি অনেকক্ষণ ধরেই তার কর্ম সারছে। ছাড়ানোর পরও রক্তপাত কম হলো না।

এখান থেকে বসে দিগন্তের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়ের কোথাও কোথাও দেখলাম পাহাড়ি ঢলের ক্ষত। তারপরও কোথাও বৈসাদৃশ ঠেকলো না। পাহাড়ের চিরকালীন হাতছানি একই রকম থাকে বোধহয়। আঁধার নেমে আসার আগে সুংসাং পাড়া ফিরতে চাইছিলাম। সেই মশার উপত্যাকা এক দৌড়ে পার হলাম। বাইরে কিছুটা আলো থাকলেও বাঁশবনের ভেতর আবছা অন্ধকার। আলো আঁধারিতে রুমনা পাড়ার গত হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর এপিটাফ ভয় ধরাতে পারে যে কোনো অন্যমনস্ক মানুষের মনে। সে সবে আতঙ্কিত হইনি। মশার আতঙ্কে এ এলাকা ছাড়তে ব্যস্ত ছিলাম যে!

undefined


সবাই আবার এক হয়ে সুংসাং পাড়ার দিকে রওনা হলাম। এবার আর কোনো তাড়া নেই। আজকের দিনের সব লক্ষ্য সফলভাবে ছুঁয়েছি। এবার ল্যাটাতে ল্যাটাতে হাঁটাই যায়। আসার পথে যে দূরত্ব আধঘণ্টায় পেরিয়েছিলাম তা পেরোতে এক ঘণ্টা লাগালাম। পাড়ায় ফেরার পর সারা শরীরে আলস্য চেপে ধরলো। সেই কোন সকালে কেওক্রাডং থেকে রওনা হয় পাসিং পাড়া, জাদিপাই পাড়া পেরিয়ে জাদিপাই ঝরনা দেখে আবার পাসিং পাড়া হয়ে সুংসাং পাড়া রুমনা পাড়া অতঃপর জিংসিয়াম সাইতার।

undefined


পথের দূরত্ব নেহাত কম না। সুংসাং পাড়ার ঝিরিতে গোসল করে গা জুড়িয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এলো তৌহিদের হাতের দুনিয়া সেরা সেই খিঁচুড়ি আর মুরগির মাংস। এমন তৃপ্তির আহারের পর ঘুম ছাড়া আর কি কিছু বাকি থাকতে পারে। না পারে না। আমরাও ঘুমের দেশে তলিয়ে যেতে সময় নেইনি। ইয়া বড় বিশাল একখানা চাঁদ আর দুনিয়া উথাল পাথাল জোছনাও সেই মহান কর্মটি থেকে আমাদের নিবৃত করতে পারেনি। কালও অনেক সকালে উঠতে হবে। ঝরনা উপাখ্যান এখনও শেষ হয়নি যে!

** অভিযান দুর্গম ঝরনা জিংসিয়াম সাইতার
** ঝরনা রানী জাদিপাই পেখম মেলে বসে...
** গা-ভর্তি জোঁক নিয়ে আকাশছোঁয়‍া কেওক্রাডংয়ে
** এভারেস্ট জয়ের ক্লান্তি নিয়ে যৌবনবতী বগালেকে
** ভরাযৌবনা শঙ্খ নদী হয়ে বগা লেকের পথে
** ২১ কিমি হেঁটে অবশেষে রুমায়!
** পাহাড়ের আড়ে বিধ্বস্ত বান্দরবানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে


বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫
এমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।