ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সিঙ্গাপুর টু মালয়েশিয়া

ইমাম হাসান সৌরভ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪
সিঙ্গাপুর টু মালয়েশিয়া ছবি: সংগৃহীত

আবার বিমানে উঠবো-ভাবতেই শুরু হলো বাড়তি উত্তেজনা। ছোট বেলা থেকেই বিমানের প্রতি আমার ব্যাপক আকর্ষণ।

গত সাত-আট বছরে অনেকবার উঠেছি, এর পরও বিমানে চড়ার আকর্ষণ একবিন্দুও কমেনি। কিছুটা নিচ দিয়ে বিমান গেলে এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত।

বিমান যাত্রায় এবারের গন্তব্য সিঙ্গাপুর হয়ে মালয়েশিয়া। সিঙ্গাপুর এর আগে আরো তিনবার গিয়েছি। উদ্দেশ্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।

মালয়েশিয়া যাওয়ার নির্দিষ্ট দিনে এয়ারপোর্টে হাজির। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে গেলাম। বরাবরের মতো এবারো কিছু উদ্ভট প্রশ্ন আর অযথা বিড়ম্বনা পোহাতে হলো। ইমিগ্রেশনের এইসব কর্মকর্তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানোর দাবি অনেক পুরনো। কিন্তু কার্যকর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি এবারো।

বিমানে ওঠার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা ভালোই কাটে। খানাপিনার পাশপাশি পাশের লোকজনের সাথে কথায় কথায় দুই তিন ঘণ্টা পার করে দেওয়া যায় অনায়াসে। শেষ দিকে অবশ্য কিছুটা বিরক্ত লাগে। ল্যান্ড করার আগের ১০-১৫ মিনিট তো খুবই অসহনীয় মনে হয়।

সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে গেলেই মন ভালো হয়ে যায়। পুরো এয়াপোর্ট বেশ পরিপাটি। আর কর্মকর্তারা কাজও করেন দ্রুত। এ জন্যই গত কয়েক বছর বিশ্বের অনেক দেশের এয়ারপোর্টকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান দখল করে আসছে চাঙ্গি এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশন পার হয়ে প্রায় ভোরে এয়ারপোর্টের বাইরে বের হলাম দল-বলসহ। এ যেন আধুনিকতার মিশেলে একটি সাজানো বাগান। মুহূর্তে সারা রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।

আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিতে গাড়ি পাঠিয়েছেন কামাল আঙ্কেল। কামাল আঙ্কেল দুই যুগ ধরে সিঙ্গাপুরে আছেন। কনস্ট্রাকশন ছাড়াও নানা রকমের ব্যবসাপাতি নিয়ে বেশ ভাল আছেন তিনি। খুব বড় মনের মানুষ। তবে, এই ব্যবস্থাপনার জন্য কৃতজ্ঞ কামাল আঙ্কেলের ছেলে রাজিবের কাছে। গভীর রাতে তার গাড়িতে চড়ে রওয়না দিলাম সেরাঙ্গুন প্লাজা এলাকায়। ভোর রাতে একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। তখনও রেস্টুরেন্টে অনেক মানুষ, মনে হচ্ছে সবে সন্ধ্যা হলো। সবাই বন্ধু আর পরিবার নিয়ে খাবার খাচ্ছেন।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই একটি খোলা ট্রাকের পেছনে বেশ কয়েকজন বাঙালিকে বসে থাকতে দেখলাম। কামাল আঙ্কেলের গাড়ির ড্রাইভার জহির জানালেন, এরা বাংলাদেশি শ্রমিক। ভোর বেলায় এদের এভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকের পেছনে করে বন্দরে নেওয়া হয় কাজের জন্য। আবার গভীর রাতে ট্রাকের পেছনে করেই গাদাগাদি করে যার যার বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এরা অল্প আয়ের শ্রমিক। সিঙ্গাপুরের মতো খরুচে দেশে অল্প আয় দিয়ে কষ্টে দিন পার করে।

ছোট ছোট রুমে এদের অধিকাংশই মানবেতর জীবন যাপন করছে বলে জানালেন জহির ভাই। তবে, অনেক বাংলাদেশি ব্যবসা বাণিজ্য করে বেশ উন্নত জীবন যাপন করছে বলেও জানালেন তিনি।

ভোরে হোটেলে চেক ইন করেই ঘুম। বিকেলের দিকে বের হলাম মেরিনা বে’র দিকে। সিঙ্গাপুর আয়তনে প্রায় আমাদের ঢাকার সমান। এরপরও কতো উন্নত। দেশের বাইরে এসে একটু আফসোস লাগে, যদি আমাদের দেশটা ওদের মতো হতো। কতো জাতি একসঙ্গে বাস করে। কিন্তু মারামারি হানাহানির কোনো খবর নাই। সবাই শুধু কাজের পেছনে ছুটছে। আইনের প্রতি সবাই বেশ শ্রদ্ধাশীল।

সিঙ্গাপুরে মাদকের ব্যাপারে বেশ কঠোর আইন বলবৎ। কথা প্রসঙ্গে কামাল আঙ্কেল জানান, বাংলাদেশ থেকে তার এক বন্ধু তার জন্য ১১ প্যাকেট সিগারেট নিয়েছিলেন। কিন্তু লোকটি জানতেন না সিঙ্গাপুরে এক প্যাকেটের বেশি সিগারেট নেওয়া নিষিদ্ধ, তাও প্যাকেট খোলা থাকতে হবে। আইন না জানার কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠাল। খবর পেয়ে কামাল আঙ্কেল মোটা অংকের টাকা জরিমানা দিয়ে তার বন্ধুকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। শুধু আইন মেনে চলায় আর পরিশ্রমের কারণেই সিঙ্গাপুর আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে বর্হিবিশ্বে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

মেরিনা বে’র সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গেলাম। শুধু মেরিনা বে’ই নয়, সিঙ্গাপুরে সৌন্দর্যের আরো বেশ কিছু জায়গা আছে। সাইট সিলিংয়ের ছাদ খোলা বাসে চড়ে অল্প সময়ে এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘোরা যায়। খরচটা একটু বেশি এই যা।

দু’দিন সিঙ্গাপুর থেকে এরপর মালয়েশিয়া গেলাম উডল্যান্ড বর্ডার দিয়ে।

এবারও কামাল আঙ্কেলের লেক্সাস গাড়ির আতিথেয়তা পেলাম। আগেও দুইবার মালয়শিয়া গিয়েছি উডল্যান্ড বর্ডার দিয়ে। মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশনে অবশ্য সিঙ্গাপুরের মতো এতো বেশি কড়াকড়ি নেই। ঝামেলা ছাড়াই পাড়ি জমালাম মালয়শিয়ায়। সীমান্তবর্তী এ শহরটির নাম জহর বাহরু। মালয়েশিয়ার উন্নত শহরগুলোর মধ্যে একটি। চারদিকে সারি সারি উঁচু দালান। দেখলেই বোঝা যায় দ্রুত উন্নত করছে দেশটি।

মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে সংস্কৃতি অনেকটা এক। সিঙ্গাপুরে ইংরেজির প্রচলনটা বেশি, তবে মালয়েশিয়ায় ইংরেজি তেমন চলে না। এছাড়া মালয় ভাষা, চায়নিজ মান্দারিন আর তামিল এদিকটায় দুই দেশ প্রায় সমানে সমান।

জহর বাহরু থেকে গেলাম সেলাসা জায়া এলাকায়। এখানে আমাদের কয়েকজন বাংলাদেশি বন্ধু আছে। তাদের আতিথেয়তায় রীতিমতো মুগ্ধ।

আশপাশে ঘোরাফেরা আর কেনাকাটায় দুই দিন পার করে দিলাম। এই এলাকাটায় অনেক বাংলাদেশি আছে। তবে, কুয়ালালামপুরের মতো এতো পলিটিক্স নেই। নেই তেমন লোক সমাগম। জীবনযাত্রার মানও খারাপ নয়, তাছাড়া সিঙ্গাপুর কিংবা কুয়ালালামপুর থেকে খরচ অনেক কম। সব মিলিয়ে রাজধানী শহর থেকে ভালোই আছেন এখানকার লোকজন।

পরদিন গেলাম কুয়ালালামপুর। কুয়ালামপুর অনুষ্ঠান শেষ করে আবার সেলাসা জায়া। সময় কম থাকায় রাজধানীটা ঘুরে দেখার সময় পাইনি।   

তিন দিন মালয়শিয়া থেকে আবার সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন পার হলাম কোনো ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু বিড়ম্বনা শুরু হলো সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেশনে। বন্ধুরা আমাকে আগেই সতর্ক করেছিলেন, চাঙ্গি এয়ারপোর্টের তুলনায় অনেক বেশি কঠোর উডল্যান্ড ইমিগ্রেশন। হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। প্রশ্নবানে জর্জরিত করলো। কত রকম প্রশ্ন ! স্মার্টলি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। অবশেষ সিঙ্গাপুর ঢোকার ছাড়পত্র পেলাম।

তবে, এবার আরেক বিড়ম্বনা। মেশিনে স্ক্যান করার পরও মালপত্র বোঝাই দু’টি লাগেজ খুলতে বললো পুলিশ। বলে কি! এগুলো খুলে আবার ঢুকাতে দেড় দুই ঘণ্টার হ্যাপা। নিজেদের পরিচয় দিয়ে খুব বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বললাম। এরপরর গাইগুই করে আবার স্ক্যান করতে বললো। তুব ভালো। আবার স্ক্যানিং মেশিনে দিলাম। এবার ছাড় পেলাম।

এবার সিঙ্গাপুরে থাকব একদিন। রাতে ব্যাপক আড্ডা হলো পুরনো আরো কিছু বন্ধুর সাথে। তপন ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় একটি টেলিভিশন স্টেশনে কাজ করেছি অনেক দিন। এখন সিঙ্গাপুরে একটি আইটি ফার্মে কাজ করছেন। ভাবিকেও নিয়ে গেছেন কয়েকমাস আগে। ভাবি কাজ করছেন মোস্তফা সেন্টারে।

ভাবিসহ তপন ভাই, আরেক আইটি এক্সপার্ট আসাদ ভাই আর তাদের এক বন্ধু  গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা, গল্প, গান বাজনা আর একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খানা পিনা। সবাই যার যার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। সব মিলিয়ে স্মরণীয় একটি রাত কাটালাম।

পরদিন রাতে ঢাকার ফ্লাইট। দিনে কামাল আঙ্কেলের সাথে তার বাসার নিচে ম্যাগডোনাল্ডসে লাঞ্চ সারলাম। হাতে এখনো অকে সময়। এ সময় তার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সামান্য কিছু কেনাকাটাও হলো। বিকেলের মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দিলাম।  

হাতে সময় থাকায় চাঙ্গি এয়ারপোর্টের এপার ওপার ঘুরে দেখলাম। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে আমি না, যে কেউ মুগ্ধ হবে। ভাবলাম, কেন তারা বিশ্বের প্রথম সারির এয়ারপোর্টের মর্যাদা পায়। চার ঘণ্টা আকাশ ভ্রমণ শেষে এক সপ্তাহ পর ঢাকায় পা রাখলাম। আবার এখনকার ইমিগ্রেশন বিড়ম্বনা। এরপরও দেশে ফেরা সব সময়ই মধুর। অন্যের দেশ যত উন্নতই হোক না কেন, এটা আমার দেশ, আমার প্রিয় জন্মভূমি।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা, লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে একদম ভুলবেন না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  



বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।