ঢাকা: গাইডের পেছনে চলতে চলতে বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। আর কতদূর... ১০ জনেরই হাত-পা কেটে একাকার অবস্থা।
দলের অন্য সদস্যদের পেছনে ফেলে আমরা দু’জন থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকলাম। হঠাৎ শ-শ শব্দ শুনতে পেলাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম এক শ’ গজ দূরে চিতা ঝর্না (হামহাম)। হুররে... চিৎকার দিয়ে উঠলাম সবাই এক সঙ্গে। বেড়ে গেল চলার গতি।

undefined
ঝর্নার কাছে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কিছুটা সময়। এ কোথায় এলাম! সাক্ষাৎ স্বর্গ!
রাত সাড়ে ১১ টায় শ্যামলী পরিবহন আমাদের নিয়ে ছুটে চলে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে। ভোর পৌনে চারটা। আমরা শ্রীমঙ্গল গিয়ে নামলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানালো অসংখ্য কুকুর।
একদল অপরিচিত মুখ দেখে তাদের উৎকণ্ঠা। আমাদের কাছে এটাই ছিল অভ্যর্থনা।
বাসষ্ট্যান্ডে বসে সময় কাটছিল না। কখন সাড়ে ছয়টা বাজবে আর আমাদের নয়ন’দা তার জিপ নিয়ে হাজির হবেন। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অবশেষে সাড়ে ছয়টা। ফোনে নয়ন’দাকে পাওয়া গেল। তিনি আসছেন। নয়ন’দা আসার পর শুরু হল আমাদের ‘হামহাম’ যাত্রা।

undefined
আমাদের নিয়ে জিপ ছুটলো ফিনলে’র চা বাগানের বুক চিরে। মাঝখানে রাস্তা, দু’পাশে সারি সারি সবুজ চা গাছ। বাগানে প্রবেশ করার কিছু পরেই চোখে পড়ল একটি বন মোরগ। আমাদের কয়েকজন বন মোরগটির দৌড়ে চিন্তায় পড়ে গেল, তারা জানত না বন মোরগ উড়তেও জানে। অনেক সময় পাখির চেয়েও ভাল।
চা বাগানের ভিতর দিয়ে আমাদের জিপটি হেলে-দুলে চলছিল। মনে হচ্ছিল যেন গ্রামের মেঠো পথ ধরে গরুর গাড়িতে চলেছি। দুই ঘন্টা পর আমাদের পাইলট নয়ন’দা জানালো, সামনে রাস্তা খারাপ তাই জিপ নিয়ে
আর এগুনো যাবে না। নেমে দেখলাম আসলেই ভয়াবহ, কোনোভাবে চাকা ফসকালে সোজা পাশের খালে।
এরই মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত গাইড (স্বপন) আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সুঠাম দেহ, যেনো পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের ‘রূপাই’।

undefined
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর কিছুদূর হেঁটে কলাবনপাড়া গ্রাম, গ্রাম পেরুলেই পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে যেতে হবে ‘হামহাম’।
গ্রামে ঢুকতেই সাত থেকে ১২ বছর বয়সী পাঁচ/ছয়টি ছেলেমেয়ে দৌড়ে এলো বাঁশ হাতে। আমাদের গাইড তাদের সবাইকে এক জায়গায় দাঁড়াতে বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে দু’টি করে বাঁশ কিনে নিল।
গাইড এবং দলনেতা দুই মিনিট করে চার মিনিট নির্দেশনা দিলো কিভাবে পাহাড়ি পথে হাঁটতে হবে। এরপর শুরু হলো আমাদের মূল অভিযান। সবাই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়ার জন্য যে যার মত প্রস্তুতি নিতে লাগল।

undefined
ইতোমধ্যে গাইড মস্ত বড় একটি ধারালো ‘দা’ (দেশিয় অস্ত্র) নিয়ে এসে বললো চলুন এবার যাওয়া যাক। আমরাও একে একে তার পিছু নিলাম। কলাবনপাড়ার পরে আর কোনো জন বসতি নেই। আর এখান থেকেই শুরু হয় হামহাম যাওয়ার আসল অ্যাডভেঞ্চার।
চারদিকে ঘনজঙ্গল, বিশেষ করে বাঁশ ঝাড়। পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে শুরু হলো আমাদের হাটা।
ছোট-বড় পাহাড়, আবার কখনও খাড়া পথ বেয়ে নিচে নামতে নামা। শুরুতেই আমাদের দলের একজন কাদার কাছে হার মেনে চিৎপটাং... আমরা তখন হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। দলনেতা সবাইকে হুশিয়ার করে বললো... দেখুন একজন আরেক জনকে সহযোগিতা করবেন, যেন কেউ পড়ে না যায়।

undefined
সেদিন আমরাই ছিলাম হামহামের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া প্রথম দল। তাই কয়েকজন স্থানীয় লোক ছাড়া যাত্রা পথে আর কারও দেখা মেলে নি। আমরা মনে করলাম আজ হয়তো আর কেউ আসবে না এদিকে। আর গাইড ও জানালো বৃষ্টি হয়েছে, লোকজন হয়তো কমই হবে।
ঝর্নার উদ্দেশে আমাদের এ ছোট্ট অভিযাত্রী দল অব্যাহত ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে আমাদের দলনেতাও পা-পিছলে... এরপর একে একে প্রায় সবাই সে দলে নিজেদের নাম লেখালাম। এর মধ্যে কয়েকবার যাত্রা বিরতি দেওয়া হলো। স্যালাইন পানি, সাফারি চকলেট ইত্যাদি খাওয়া-দাওয়া।
আবার চলা শুরু। একটি জায়গায় এসে আমরা পানির শব্দ শুনতে পেলাম, গাইড জানালো ওইটাই হামহামের ঝর্নার শব্দ। মন অনেকটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল, তাহলে আমরা চলে এসেছি হামহাম!

undefined
কিন্তু আমাদের হতাশ করে গাইড জানালো আমরা যতখানি পথ এসেছি আরো ততখানি পথ আমাদের সামনে যেতে হবে। এ যেন অনন্ত পথ যাত্রা, শেষ হতে চায় না। সবাই কাদা পানিতে একাকার হয়ে গেলাম। সাড়ে তিন ঘন্টা হাঁটার পর উচু একটা পাহাড়ের উপর নিজেদের আবিষ্কার করলাম আমরা।
গাইড জানালো এ পাহাড়ের নিচেই ঝিরিপথ (ঝর্নার পানি বয়ে চলা পথ)। তারপর এ পথে ১০ মিনিট হাটলেই কাঙ্খিত চিতা ঝর্ণা হামহামের দেখা পাওয়া যাবে।
আর এখন দিতে হবে আসল পরীক্ষা। পাহাড় থেকে নামার পথটা অনেক ভয়ানক। একেবারে ১১০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল। গাইড আরও জানালো এখানে এসে অনেক পর্যটক ফিরে গেছেন এমন নজিরও আছে।

undefined
আমরা প্রস্তুতি নিলাম আসল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। মজার বিষয় হলো- এ কঠিন পথটি আমি এবং সাচ্চুভাই খুব সহজেই অতিক্রম করে ঝর্ণার পানিতে নেমে গেলাম। পানিতে পা-দিয়েই আমরা অবাক। এ দেখি একেবারে ফ্রিজের শীতল পানি।
এর অনেকটা সময় প্রায় ২৫ মিনিট পর সবাই একত্রিত হলাম ঝিরিপথে। আরও ১০ মিনিট গাইডের পিছনে চলার পর আমি আবিষ্কার করলাম আমাদের বহুকাঙ্খিত সেই সাক্ষাৎ স্বর্গ ‘হামহাম’। মুহুর্তেই শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠল। দূর হয়ে গেল পথ পাড়ি দেওয়ার সকল ক্লান্তি।
মনমুগ্ধকর এ ঝর্নার স্বচ্ছ শীতল পানি দেখে কেউ আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারি নি। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। এ যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ।

undefined
অবস্থান: সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার (রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিট) শেষ গ্রাম কলাবনপাড়া। তৈলংবাড়ি নামেও জায়গাটি পরিচিত।
যাতায়াত: ঢাকা থেকে মৌলভী বাজারের যে কোনো বাসে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা কিংবা জিপে চেপে কলাবনপাড়া। পাঁচ জনের কম হলেই অটোরিকশায় ভাল হয়। তবে বেশি হলে জিপই ভরসা। রিজার্ভ আপ-ডাউন জিপ ভাড়া নেবে ২৫ শত টাকা। আর অটোরিকশায় এক হাজার টাকা। সঙ্গে গাইড নিতে ভুলবেন না। গাইডের ফি পাঁচ শ’ টাকা।

undefined
সাবধানতা: যাওয়ার সময় সঙ্গে অবশ্যই সরিষার তেল আর লবণ রাখতে হবে। কেননা প্রচুর জোঁকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই দুটি ব্যবস্থাই কার্যকরী। হাতে একটা ছোট বাঁশের টুকরা বা লাঠি খুবই কার্যকর। এতে পাহাড়ি পথে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা থেকে শুরু করে সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণীর হাত থেকে নিরাপদ থাকা যায়। এছাড়াও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর খাবার স্যালাইন রাখতে ভুলবেন না। জীবাণুনাশক ক্রিম আর তুলাও সঙ্গে নেবেন।
যেখানে থাকবেন: কলাবন পাড়ায় থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। আগের দিন শ্রীমঙ্গলে পৌঁছলে এক রাত সেখানে থেকে পরদিন খুব ভোরে উঠে রওয়ানা দিয়ে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার পরে শ্রীমঙ্গল ফিরতে পারেন।

undefined
খরচ: ৪/৫ জনের গ্রুপে খরচ হবে মাথাপিছু আড়াই হাজার টাকার মতো।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা, লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে একদম ভুলবেন না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

undefined
বাংলাদেশ সময়: ০০২১ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৪