টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে: শত বছর আগের কথা। পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য, আর স্থানীয় জমিদারের রূপবতী কন্যা মাথিন।
এই মহাকাব্য সংক্ষেপ পড়তে আমরাও গিয়েছিলাম টেকনাফ মডেল থানা কমপ্লেক্সে। কমপ্লেক্সের ফটক পেরিয়েই দেখা মিললো ‘মাথিন হেরিটেজ’ নামফলক। মাথিন এখনো যে এ এলাকার প্রেমের কিংবদন্তি তা নামফলক দেখেই বোঝা গেলো। ডানে তাকাতেই চোখে পড়ল টিনের ছাউনির একটি ছোট কমপ্লেক্স। বেশ সাজানো গোছালো।

undefined
মাঝারি আকারের রডের তৈরি ঢাকনিতে ছাওয়া একটি কূপ, কূপের সামনে বড় কালো বোর্ডে একটি প্রেম উপাখ্যান এবং পাশে একজন সুঠাম দেহী যুবকের প্রতিমূর্তি।
ঘটিনাটি এমন ‘বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, কলকাতার সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য অতি ভয়ংকর ও দুর্গম এলাকা টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। সবুজ পাহাড় ঘেরা টেকনাফ থানা-অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি। থানায় তার তেমন কোনো কাজ ছিল না। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে সময় কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে। একদিন ভোরে একাধিক নারী কণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙে যায়। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখেন, রঙ-বেরঙের ফতুয়া (থামি-ব্লাউজ) পরিহিতা ৫০/৬০ জন মগী রাখাইন তরুণী পাতকূয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানা প্রাঙ্গণ মুখরিত।

undefined
এটিই ছিল সমগ্র টেকনাফে একটি মাত্র কুয়া। প্রতিদিন তরুণীরা পাতকূয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন। একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুণীকে, সুন্দরী এই তরুণীর নাক-চোখ-মুখ বাঙালি মেয়েদের মতো। নাম তার মাথিন। টেকনাফের জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র মেয়ে। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচার্য থানার বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসতেন এবং মাথিনের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন। মাথিন যখন কলসি কাখেঁ তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাঙ্গণ দিয়ে হেঁটে আসতেন, ধীরাজ তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্য তরুণীরা আসার আগেই মাথিন পাতকূয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন।

undefined
ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সঙ্গে গভীর প্রেম ও মোহাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে সম্ভব-অসম্ভব নানা কল্পনার রঙিন জাল বুনতেন। দেখাদেখি-হাসাহাসি চলতে থাকে। প্রেম ঘনীভূত হয়। দিন গড়াতে থাকে। একদিন-দু’দিন। ইতোমধ্যে দু’জনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়।
এরই মাঝে কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। কলকাতা যেতে হবে একমাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতায় যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হলো। মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

undefined
ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। মাথিনের মনে হলো বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ বরং বিয়ে করার ভয়েই পালিয়েছেন। প্রাণপুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্ন-জল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়াথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শতো চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্ন-জল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এককথা-ধীরাজকে চাই। প্রেমের এই বিচ্ছেদে এবং অতিকষ্টে একদিন মাথিন মারা যান।
ধীরাজেরই লেখা ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ বইয়েই এই প্রেমকাহিনী জানা যায় বলে বোর্ডের লেখায় উল্লেখ করা হয়। তবে স্থানীয়রাও অবগত এ কাহিনী।
ধীরাজ-মাথিনের প্রেম নিদর্শন দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমান অনেক মানুষ। অনেকে এসে আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়েন। আমাদের সামনেও ঘটলো এমন একটি ঘটনা। এক যুবক এখানে এসে যেন ফিরে গেলেন একশো বছর আগে। যেন তারই প্রেমকাহিনী রোমন্থন করছেন। তার ভেজা চোখ বলে দিলো অনেক না বলা কথা।

undefined
জানা যায়, ১৯০৫ সালে যশোরে জন্ম নেওয়া ধীরাজ টেকনাফ থেকে ফিরে যাওয়ার পর আর পুলিশের চাকরিতে ফেরেন নি। পরবর্তী জীবনে চলচ্চিত্র পর্দায় দেখা যায় সুদর্শন ধীরাজকে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। প্রেমে সফল হলেও পরিপূর্ণতা পায়নি, তবে সফল তার চলচ্চিত্র জীবন।
‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এর পাশাপাশি ‘যখন নায়ক ছিলাম’ শীর্ষক আরেকটি বইও লেখেন ধীরাজ। ১৯৫৯ সালে মারা যান এই পুলিশ-নায়ক-প্রেমিক! তবে তার পরবর্তী জীবন নিয়ে এর বেশি কিছু আর জানা যায় নি।
** খেতে ভুলবেন না আইনচি
** সোনাদিয়া, সম্ভাবনাময় সোনার দ্বীপ
** মিষ্টি পানের সবুজ দ্বীপ
** খাবারের সন্ধানে সাঁতারু গাভী!
** অটল পাহাড়ের বুকে উদ্দাম সাগর
** শারদ মেঘের দেশে, পাখির ডানায় ভেসে
** গরম গরম ফিশ ফ্রাই
** মহাপতঙ্গের পেটে একঘণ্টা!
** রিজেন্টে ফ্রি কক্সবাজার দর্শন
বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৪