ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তারার ফুল

‘পিকে’ : ভারতে বিতর্ক আর উৎসাহ তুঙ্গে

স্মিতা সাহা, কলকাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
‘পিকে’ : ভারতে বিতর্ক আর উৎসাহ তুঙ্গে ‘পিকে’ ছবির দৃশ্যে আমির খান ও আনুশকা শর্মা

কলকাতাঃ আমির খান অভিনীত ও রাজকুমার হিরানী পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘পিকে’ নিয়ে গোটা ভারত জুড়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক চাঞ্চল্য। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ‘পিকে’  সিনেমা প্রদর্শনে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

অনেক জায়গায় প্রেক্ষাগৃহ ভাঙচুর এর খবর এসেছে।

ভারতের আমেদাবাদে ভাংচুর করা হয়েছে প্রেক্ষাগৃহে। অভিযোগ ‘বজরং দল’-এর সমর্থকরা এই ভাঙচুর করেছেন। অন্যদিকে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড’-এর তরফে ‘পিকে’ -কে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান হয়েছে। এই একই দাবি করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তবে লক্ষণীয় বিষয় ‘পিকে’  নিয়ে মুখ খোলেনি ভারতের কোন রাজনৈতিক দল।

প্রতিবাদীদের তরফে এও বলা হয়েছে ‘লাভ জিহাদ’ কে সমর্থন করা হয়েছে ‘পিকে’  চলচ্চিত্রে। কারণ ভারতের  মেয়ের সঙ্গে পাকিস্থানের একটি ছেলের প্রেমের সম্পর্ক দেখান হয়েছে।

কিন্তু মাত্র তিন দিনে ৯৫ কোটি রুপির ব্যবসা করে এবং মাত্র ১০ দিনে ২৯ ডিসেম্বর অব্দি হিসেবে সমস্ত ইতিহাস ভেঙ্গে ৪৩৩ কোটি রুপির ব্যবসা করেছে ‘পিকে’ । ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যা এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। তবে প্রথম স্থানটি দখল করতে আর বেশি দেরি নেই এই ছবির।

কিন্তু কি এমন আছে এই ছবিতে যেখানে হিন্দু সংগঠন এবং মুসলিম সংগঠনের তরফ থেকে প্রেক্ষাগৃহে ভাঙচুর করতে হল আর অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় দর্শক দেশের প্রায় ৫ হাজার প্রেক্ষাগৃহে প্রতিদিন উপচে পড়ছে।

এই বিপুল মানুষের উৎসাহ এবং তার ঠিক উল্টো দিকে প্রেক্ষাগৃহ ভাঙচুরের মত ঘটনার  সুলুক সন্ধান করতেই কলকাতার এমনই এক প্রেক্ষাগৃহে হাজির হয়েছিল বাংলানিউজ। শুধু ‘পিকে’  দেখা নয় প্রেক্ষাগৃহ ফিরত দর্শকের সঙ্গে এই নিয়ে কথাও বলা হয়েছিল বাংলানিউজের তরফ থেকে।

সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে দেখা যাক যে চলচ্চিত্র নিয়ে গোটা ভারতে এই তীব্র বিতর্কের সাথে সাথে ভয়ঙ্কর উৎসাহের জন্ম নিয়েছে তার গল্পের দিকে।

মূল চরিত্রে আমীর খান একজন ‘এলিওন’ বা ‘মহাজাগতিক প্রাণী’ সে পৃথিবীতে আসতেই আসতেই তার নিজের গ্রহে ফেরার যন্ত্রটি চুরি হয়ে যায়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ভাষা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন আদব কায়দা রপ্ত করে আমীর খান রুপি ‘পিকে’ ।

কিন্তু তার কাছে অদ্ভুত লাগে এই পৃথিবীর সভ্যতার নামে চলতে থাকা অনেক কিছুই। আর তার শিশুর মত সরল মনে আসা নানা প্রশ্ন করে ফেলার ফলেই তাকে লোকজন নাম দেয় ‘পিকে’। ইন্দিতে ‘পিকে’ শব্দের অর্থ মাতাল।

আসলে ‘পিকে’  –এর প্রশ্ন গুলির কোন উত্তর জানা নেই এই তথাকথিত  সভ্য পৃথিবীর। ‘পিকে’  –এর গ্রহে কেউ পোশাক পড়েনা। যখন জগৎজননী ওরফে জগগু ভূমিকায় অভিনয় করা অনুস্কা শর্মা জানতে চান ‘পিকে’ -এর গ্রহে নারী-পুরুষের পোশাক না পড়া অশালীন বলে মনে করা হয় না কেন।

এর উত্তরে ‘পিকে’  জানায় প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণী, পশু-পাখি কেউই পোশাক পড়ে না। কিন্তু তাদের দেখে কি অশালীন মনে হয়। ‘পিকে’ -এর বক্তব্য যদি পোশাকের দরকার হোতো তাহলে জন্মের সময়ই শিশুর গায়ে পোশাক থাকত।

এখানেই শেষ নয়। ‘পিকে’  গোটা ছবিতে বারবার প্রশ্ন তুলেছে চলমান সভ্যতার নানা দিক নিয়ে। যে প্রশ্ন গুলির কোন উত্তর সভ্য সমাজের কাছে জানা নেই। যৌনতা নিয়ে ‘পিকে’ -এর প্রশ্ন, যদি বিবাহ উপলক্ষে প্রচুর মানুষকে নিমন্ত্রণ করে জানান যায় তবে যৌনতা নিয়ে এত ঢাকা চাপা কেন?

‘পিকে’ -এর বক্তব্য যৌনতা যখন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তখন তাকে নিয়ে এত গোপনীয়তা কেন? সত্যি কি তথাকথিত সভ্য সমাজের সঠিক কোন উত্তর জানা আছে এই প্রশ্নের?

তবে এখানেই শেষ নয় , ‘পিকে’ -এর প্রশ্নের এখানে শুরু। হাসির মোড়কে এখান থেকেই প্রশ্ন গুলিকে উশকে দিয়েছে ‘পিকে’ । ‘পিকে’  পৌঁছে গেছে হাসপাতালে। সেখানে সে দেখেছে জন্মের সময় শিশুদের শরীরে কোন আলাদা আলাদা ধর্মের চিহ্ন দেওয়া থাকে কিনা।

সে যখন বুঝতে পারে আসলে জন্মের সময় কোন ধার্মিক পরিচয় থাকে না একটি মানব শিশুর তখন সে অবাক হয় কেন তবে ধর্ম নিয়ে এত লড়াই। তার প্রশ্ন তবে কি মানুষের জীবনে ধর্ম পরবর্তী সময়ে যোগ করে দেওয়া একটি পরিচয় মাত্র।

‘পিকে’ -তার হারিয়ে যাওয়া যন্ত্রটি খুঁজতে পৃথিবীর মানুষদের কথা মতো দেবতার কাছে প্রার্থনা করে। শুধু একটি ধর্ম নয় ভারতীয়  উপমহাদেশে  প্রচলিত সব ধর্মের ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করে ‘পিকে’ । কিন্তু তার যন্ত্র সে খুঁজে পায় না।

এখানেই শুরু হয় নতুন গোলমাল। প্রণামী দিয়ে পুরহিতের কাছে তার যন্ত্র ফিরত পাবার প্রতিশ্রুতি চেয়ে বসে ‘পিকে’ । সহজ সরল হিসেব, অর্থ দিয়েছি কাজ করে দিতে হবে। কিন্তু সে তো জানে না দেবতাকে প্রশ্ন করা যায় না। তাই জোটে গলাধাক্কা।

ঠিক তেমন গলাধাক্কাই জোটে চার্চে নারকেল, ফুল আর প্রদীপ নিয়ে উপাসনা করতে গেলে। ‘পিকে’  অবাক হয় দেবতার উপাসনায় মন্দিরে নারকোল দেওয়া হলে চার্চে তা নিষিদ্ধ আবার চার্চে যিশুকে ‘ওয়াইন’ দেওয়া হয় মসজিদে তা নিষিদ্ধ।

‘পিকে’  এবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় গোটা সমাজের দিকে। মানুষের তৈরি নিয়মে কেন বাঁধা পড়ে আছেন মানুষের সৃষ্টি কর্তা। তবে কি মানুষ তৈরি করেছে ঈশ্বরকে?

যদি মানুষ ঈশ্বরের সন্তান হয় তবে কিভাবে একজন পিতা তার সন্তানকে নানা শারীরিক কষ্ট আর যন্ত্রণা, এবং অর্থের বিনিময়ে তার কাজ করে দেবার কথা বলেন?

কমেডির মোড়কে এই রকম প্রশ্নই তুলেছে ‘পিকে’ । তবে এখানেই শেষ নয়। অবশেষে ধর্মের ব্যবসায়ীদের হাত থেকে উদ্ধার হয় ‘পিকে’ -এর চুরি হয়ে যাওয়া রিমোর্ট। নিজের গ্রহে ফিরে যায় ‘পিকে’ ।    

চলচ্চিত্রের শেষ অংশটিতে দেখা যায় আবার ফিরে আসে ‘পিকে’  তবে তার নতুন সঙ্গীদের নয়ে। তারা বুঝতে চায় সভ্য সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দ্বিচারিতা গুলিকে। ছড়িয়ে পড়ে ‘পিকে’ -রা।

একদিকে এই চলচ্চিত্র নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে হামলা চালিয়েছে বজরং দল, অন্যদিকে এই চলচ্চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিজেপি-এর বরিষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি।

একদিকে এই চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়েছে  ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড’ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অন্যদিকে এই চলচ্চিত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছে লক্ষলক্ষ ভারতবাসী।

‘পিকে’   দেখে বেড়িয়ে দর্শকরা জানিয়েছেন আধুনিক ভারত এই কথাই বলতে চাইছে। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চাইছে, আধুনিক ভারত মুক্ত হতে চাইছে ধর্মের কারবারীদের তৈরি বাঁধন থাকে।

দর্শকরা আরও জানিয়েছেন আধুনিক ভারত প্রশ্ন করতে শুরু করছে আর তাই ভায় পাচ্ছে ধর্মের ব্যবসায়ীরা। আর তাই জন্যই হামলা চালাচ্ছে প্রেক্ষাগৃহে।

আগামী ৪ তারিখ কলকাতার নন্দন –অ্যাকাডেমি চত্বর থেকে  এই হামলার বিরুদ্ধে মিছিলে হাঁটবেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা।

পরিশেষে বলয়ায় ‘পিকে’  ভারতীয় সিনেমায় একটি মাইল ফলক যা আগামী দিনে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হবে।

ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন শান্তনু মৈত্র। ছোট ভূমিকায় সঞ্জয় দত্ত অসাধারণ অভিনয় করছেন। মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন বমন ইরানী এবং ছবির নায়িকা অনুষ্কা শর্মা।    

ভারতে মোট ৮ হাজার প্রেক্ষাগৃহে এবং বিদেশে ৫ শো প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘পিকে’ । তবে বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হয় ভারতের ‘সেন্সর বোর্ড’-কে। তারা এক্ষেত্রে ভারতের ভবিষ্যৎ সময়ের বক্তব্যটি যথাযথ অনুভব করতে পেরেছেন।

প্রেক্ষাগৃহ থেকে ছবি দেখে বেড়িয়ে এক পৌঢ়ের উক্তি দিয়েই একটি বাক্যে চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে বোঝা যায়, তার বক্তব্য, ভারতীয় সমাজ যে পরিণত হচ্ছে তা এই ছবির সাফল্য দেখেই অনুমান করা যায়।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, ৩১ ডিসেম্বর , ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ