ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

বড় অর্জন ৭ মার্চ ভাষণের স্বীকৃতি, বড় বোঝা রোহিঙ্গা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৮
বড় অর্জন ৭ মার্চ ভাষণের স্বীকৃতি, বড় বোঝা রোহিঙ্গা বাঁয়ের ছবি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মুহূর্ত, ডানের ছবিটি নিথর হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শিশুকে নিয়ে মায়ের আহাজারির

ঢাকা: বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে এবং অনেক আলোচনার জন্ম দিয়ে বিদায় নিয়েছে ২০১৭ সাল। বিশ্ব প্রবেশ করেছে নতুন এক বছরে, ২০১৮। এখন চলছে বিদায়ী বছরের হিসাব মেলাবার পালা। বাংলাদেশও মেলাতে বসেছে সে হিসাব। আন্তর্জাতিক অর্জনের হিসাবের খাতায় জ্বলজ্বল করছে সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ৭ই মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণের ইউনেস্কো স্বীকৃতি। আর দেশের কাঁধে বোঝা হিসেবে দেখা যাচ্ছে সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার আশ্রয়। মোটাদাগে এ দু’টি বিষয়ই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও এ বছর কূটনৈতিক পর্যায়ে বেশ ব্যস্ত সময়ই গেছে।

রোহিঙ্গা সংকট
সদ্যবিদায়ী বছরের আগস্টের পর থেকে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ এক চরম ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। স্মরণকালে এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পড়েনি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সবশেষ হিসাব অনুযায়ী সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ঢাকা বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে তাৎক্ষণিকভাবে এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সারাজীবন তাদের  রাখতে রাজি নয় বাংলাদেশ। তাই সরকার সর্বাত্মক কূটনীতি প্রয়োগে সোচ্চার ছিল এক্ষেত্রে।

আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হলে এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেপ্টেম্বরে  জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যান। সেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের রক্ষা ও তাদের ফেরত নিতে জাতিসংঘে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতাদের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
 
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেস মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নিধনযজ্ঞকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে আখ্যা দেন। এ সংকট সমাধানের পূর্ব শর্ত হিসেবে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি জানান। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দফায় দফায় বৈঠক করে। সেখানে বেশির ভাগ দেশের প্রতিনিধি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধ ও সেখানে মানবিক সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান।
 
রোহিঙ্গা সংকট দেখতে বাংলাদেশ সফর করেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি, প্রধানমন্ত্রী, মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জর্ডানের রানিসহ অনেক বিশ্বনেতা। তারা রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকট মোকাবেলায় নিজেদের সরকারের বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানান। একইসঙ্গে এ সংকট নিরসনে মিয়ানমারের প্রতি জোর দাবি জানান।

বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে নিপীড়ন কিছুটা থামায় মিয়ানমার। এরপর নভেম্বরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ চুক্তি করে মিয়ানমারের সঙ্গে। সবশেষ ঢাকায় গত  ১৯ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। আশা করা হচ্ছে, এই জানুয়ারির শেষ দিকে রোহিঙ্গা ফেরানোর কার্যক্রম শুরু হবে।  

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্বীকৃতি
দেশের অন্যতম সেরা অর্জন হিসেবে লেখা থাকবে বিদায়ী বছরে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে দেওয়া স্বীকৃতি। ৩০ অক্টোবর প্যারিসে জাতিসংঘের সংস্থাটির সদরদফতরে ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ঘোষণা দেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী ভাষণটি ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য)। এ অর্জনে দেশের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যায়ে এ স্বীকৃতি উদযাপন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর ও অর্জন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদায়ী বছরে বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেন। ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) লিডার্স সামিটে যোগ দিতে ৬ মার্চ তিনি জাকার্তা গিয়েছিলেন। সামিটে মূল অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিমন্ত্রী ড. মাইথা সালেম আর শাসসির সঙ্গে। তিনি এ অঞ্চলের জন্য দক্ষ নাবিক পুল তৈরিতে বাংলাদেশে ভারত মহাসাগরীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেরও প্রস্তাব করেন।  
 
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ৮ এপ্রিল ভারতে যান প্রধানমন্ত্রী। তার এ সফরে চুক্তি-সমঝোতা স্মারকসহ ৩৬টি দলিল সই হয়। তিস্তা চুক্তির জট না  খুললেও সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে বলেন, ‘এ সফরে আমি সম্পূর্ণ তৃপ্ত, ফলপ্রসূ হয়েছে। সম্মানের দিক থেকে আমরা সমান-সমান, এটা তৃপ্তির। এখানে হতাশার কিছু নেই। এই সফর সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। ’ 

মাঝে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদান করে তিনি যুক্তরাজ্য হয়ে দেশে ফেরেন।

প্রধানমন্ত্রী ৩ ডিসেম্বর তিন দিনের সফরে যান কম্বোডিয়া। এই সফরে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পাশাপাশি পর্যটন, কৃষি, বেসামরিক বিমান চলাচল, আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং নয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তিনি কম্বোডিয়ার রয়্যাল প্যালেসে রাজার দেওয়া রাজকীয় অভ্যর্থনাও গ্রহণ করেন।

সবশেষ ১১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ওয়ান প্ল্যানেট সামিটে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। সামিটের সহ-আয়োজক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের আমন্ত্রণে এ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি।  

বাংলাদেশে বিদেশি নেতাদের আগমন
শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ১২ জুলাই বাংলাদেশে আসেন। ২০১৫ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটি ছিল তার প্রথম ঢাকা সফর। তার সফরকালে দুই দেশের মধ্যে প্রধানত ব্যবসা ক্ষেত্রসহ মোট ১৪টি ক্ষেত্রে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়।

ঢাকায় ১ নভেম্বর আট দিনব্যাপী ৬৩তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্স (সিপিসি) অনুষ্ঠিত হয়। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) এ সম্মেলনে ৫২টি দেশের ১৮০টি জাতীয় এবং প্রাদেশিক সংসদের সংসদ সদস্যসহ প্রায় সাড়ে পাঁচশ’র বেশি প্রতিনিধি অংশ নেন। এর মধ্যে ৫৬ জন স্পিকার এবং ২৩ জন ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। ২০১৬ সালে  হলি আর্টিজানের ঘটনার পর এ বছর এতো বড় সম্মেলন আয়োজন বাংলাদেশের জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, যা ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সিপিএ’র ভাইস প্যাট্রুন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এছাড়া, রোহিঙ্গা সংকট তৈরির পর বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান বা শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর করেন এবং রোহিঙ্গা সংকট তাৎক্ষণিকভাবে সামাল দেওয়ায় ঢাকার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

পুরস্কার
বর্তমান সরকার কাজ করছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বীকৃতি হিসেবে বিদায়ী বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) পুরস্কার-২০১৭’ পায় বাংলাদেশ। জাতিসংঘের আইসিটি সংক্রান্ত বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদরদফতর জেনেভায় ১৩ জুন এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৭
কেজেড/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।