ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

'জেনোসাইড ডিনায়াল আইন' এখন সময়ের দাবি

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৫
'জেনোসাইড ডিনায়াল আইন' এখন সময়ের দাবি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা কত? কোথায় যেন দেখলাম এক কোটিরও বেশি। তবে অফিসিয়ালি বলা হয় সংখ্যাটি ষাট লাখ।

সম্প্রতি গবেষকরা মৃতের সংখ্যা এক কোটির বেশি বলেই ধারণা করছেন। প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আসলে কত? হুবহু ষাট লাখ নাকি একটু কম বেশি? এই সংখ্যাগুলো কীভাবে নির্ধারিত হয়?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত? আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংখ্যাটি ত্রিশ লক্ষ। প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে প্রদত্ত এক সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ বলেই উল্লেখ করেছিলেন।

এই নিয়ে বাংলাদেশে কারো কোন সন্দেহ নাই, শুধু মাত্র স্বাধানতা বিরোধী জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসর ছাড়া আর কেউ এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে না। জামায়াত এবং তার কুলাঙ্গার সন্তানদের মিথ্যাচারের কারণটাও বোধগম্য। তাদের দেহটা বাংলাদেশে থাকলেও শেকড়টা পাকিস্তানে। তারা একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উত্তরসূরী। অনেকদিন আগে খবর পেয়েছিলাম, জামায়াত নাকি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজেদের লোক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের নামের তালিকা সংগ্রহ করছে! ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো উদ্দেশ্যটাও বোঝা যায়। একসময় সাংবাদিক সম্মেলন করে হয়তো একাত্তরে মাত্র কয়েক হাজার লোক মারা গেছে বলে ঘোষণা দিত। বর্তমানের রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশে জানি না তাদের এই কুগবেষণা প্রকল্পের অবস্থা কী?

সম্প্রতি ঢাকায় তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জামায়াত-শিবিরের সুরে সুর মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আগে থেকেই তার লন্ডনে নির্বাসিত দুর্নীতিবাজ পুত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির প্রকল্প নিয়ে নেমেছেন, তবে এখন পর্যন্ত তেমন হালে পানি পাননি। এবার এই বিতর্কে শামিল হয়ে খালেদা জিয়া বর্তমান প্রজন্মের তোপের মুখে পড়েছেন! বর্তমানের নবীন প্রজন্ম সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে তাকে তুলোধুনা করছে। জানি না, তিনি এসব খবর জানেন কী না! তবে বর্তমান অবস্থানের মধ্য দিয়ে তিনি জাতির সমস্ত সংশয় দূর করে দিয়ে নিজের মুখোশটা উন্মোচন করে দিয়েছেন। তিনি নিজেও যে পাক-জামায়াত-শিবিরপন্থী, এদের বাংলাদেশি গডমাদার, তা নিয়ে এখন আর দেশবাসীর কোন সন্দেহ থাকল না। এখন থেকে তাই জামায়াত-শিবির-জঙ্গিদের পাশাপাশি তার ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

পত্রিকায় এবং ফেসবুকে দেখলাম, অনেকেই বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা যাই হোক, পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা যে গণহত্যা সংগঠিত করেছিল তাতে তো কোন সন্দেহ নাই। সুতরাং এত বছর পরে শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার বিভ্রান্তি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এর আগে তিনি একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনো এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেননি। আজ হঠাৎ পাকিস্তান আর জামায়াত-শিবিরের সাথে কণ্ঠ মেলানো কেন? এর উত্তর অবশ্য আমাদের অজানা নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান ও জামায়াতের স্বার্থ রক্ষার জন্যই একদা বিএনপির জন্ম হয়েছিল। জন্মের সেই ঋণ আজ অব্দি শোধ করে চলেছেন খালেদা -তারেক গং। আজকের প্রতিকূলতায় গলাটা সঙ্গত কারণেই একটু বেশি চড়া!

বাংলাদেশ বলেই হয়তো এটা সম্ভব। খালেদা-তারেক কিংবা জামায়াতিরা ইচ্ছেমত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করছেন! জার্মানিতে যদি কেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে, তার জন্য জেনোসাইড (হলোকাস্ট) ডেনিয়াল আইনে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। শুধু জার্মানিই নয়, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের দশটিরও বেশি দেশে অনুরূপ আইন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জামায়াত-বিএনপির ধারাবাহিক ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টার প্রতিরোধে আজ সময় এসেছে বাংলাদেশেও এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের। আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যা ইচ্ছে তা বলা নয়! মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় অহংকার, এর ইতিহাসের কোন বিকৃতি শাস্তি যোগ্য অপরাধতুল্য।

পুনশ্চ: আট বছর আগে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে সিডনিতে কাজ করতে গিয়ে বেশ নথিপত্র ঘাটতে হয়েছে। তখনো মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হত। এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত ঘেটে জেনেছি, একাত্তরে দেশে-বিদেশে প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমসমূহে নানা সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বনিম্ন সংখ্যাটি ছিল দশ লাখ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যাটি ছিল ষাট লাখ। ত্রিশ লাখ সংখ্যাটি এর মাঝামাঝি একটা সংখ্যা যা গাণিতিক হিসেবেও গ্রহণযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সরকারও হয়তো এরকম একটি ধারণা থেকেই শহীদের সংখ্যা 'ত্রিশ লক্ষ' নির্ধারণ করেছিলেন। সুতরাং, ত্রিশ লাখ সংখ্যাটি স্রেফ কারো মুখ ফস্কে বেরোনো কোন সংখ্যা নয়, বরং অত্যন্ত সুবিবেচিত, যৌক্তিক একটি সংখ্যা। যদিও সেসময়ে বিভিন্ন জনপদে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা যেভাবে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করেছেন, পাখির মত মানুষ  হত্যা করেছেন, সে সম্পর্কে পড়াশুনা করে আমার মনে হয়েছে, ত্রিশ লাখ নয়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি!

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন। কবি ও চিকিৎসক, অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।