ঢাকা, শনিবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

রাষ্ট্র সংস্কার

আমাদের স্বপ্নটা খুব বেশি না

অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫
আমাদের স্বপ্নটা খুব বেশি না গ্রাফিতি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছবি: শেখ হাসান

একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছ থেকে মূল চাওয়াটা হচ্ছে, আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পরিবর্তন, ক্ষমতার বিভাজন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলে যেসব প্রতিষ্ঠান একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতর দায়বদ্ধতা আনে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীন পদচারণ। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখি, নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা একবার গণতন্ত্রে ফেরত এলাম।

তারপর মোটামুটি দুটি ভালো সরকার—একটা আওয়ামী লীগ, একটা বিএনপি পেলাম। তার পর একেকটি দলের যখন দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হলো, তখন থেকেই গণতান্ত্রিক আদর্শগুলো ধারাবাহিকভাবে ক্ষয় হতে থাকল।

এটারই শেষ রূপ আমরা দেখেছি গত প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনে।
আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে একটা পর্যায়ের পর খুব বড় পার্থক্য যে ছিল তা কিন্তু নয়। দুটিই মূলত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটা সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে হেঁটেছে। আসলে দুটি দলের মধ্যে একটা তৈরি করা তফাত ছিল—কে স্বাধীনতার পক্ষে আর কে স্বাধীনতার বিপক্ষে।

এই তফাত তৈরি করে সমাজকে বিভক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এটা করা হয়েছে।

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ছিয়ানব্বইয়ে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, সেই পাঁচ বছরে কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের একটা রূপ ছিল। সেই সরকারের মন্ত্রিপরিষদে অনেকেই ছাত্র ইউনিয়ন বা এই ধরনের সংগঠন করে আসা লোকজন ছিল।

এর পরের মেয়াদগুলোর দিকে তাকালে দেখি, অধিকসংখ্যক ব্যবসায়ী শ্রেণি ক্ষমতায় চলে এসেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের জায়গায় আর যেতে চাইল না দলটি। নির্বাচনকে এক ধরনের পাশ কাটিয়ে ক্ষমতায় থাকার পরিণতিটা আমরা ১৬ বছর ধরে দেখলাম। গণতান্ত্রিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একেবারেই ধ্বংসের মুখে চলে গেছে। এই ধ্বংসটা হয়েছে কয়েকভাবে।

প্রথমত, ক্ষমতার কোনো বিভাজন নেই, যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিই দলের প্রধান, তিনিই আবার সংসদেরও প্রধান। এর মধ্য দিয়ে আমরা ক্রমাগত এক ব্যক্তির শাসনের দিকে চলে গেলাম। পরিবারতন্ত্র কায়েম হলো। নির্বাচন না থাকায় এই পরিবারতন্ত্রকে জবাবদিহির মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী সরকারের অনেক কিছু নিয়মের মধ্যে হতে দেয়। কিন্তু আমরা কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম হতে দেখলাম। সংসদ একেবারে অকেজো একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। মানবাধিকার কমিশনের কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, সে অনুযায়ীই চলল কমিশন। দুর্নীতি দূর করা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা বহাল রাখার প্রতিষ্ঠান দুদকে যে লোকবল দেওয়া হলো তারা সেই পরিবারতন্ত্রের আজ্ঞাবহ। যাকে ধরা দরকার তাকে আর ধরা হলো না।

ভালো অর্থনীতির পূর্বশর্ত ভালো রাজনীতি। তার বদলে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত সিদ্ধান্ত পেলাম। সম্প্রতি শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এটা আর ক্রনি ক্যাপিটালিজমও [স্বজনতোষী পুঁজিবাদ] থাকল না, চোরতন্ত্রে পরিণত হলো। একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে ব্যাংকগুলোকে ভেঙে ফেলা হলো। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দেখালেন, ১৬ বছরের প্রতিবছর ১৬ বিলিয়ন ডলার আমাদের ব্যাংকগুলো থেকে পাচার হয়ে গেছে। এই দেশের অর্থনীতি তাহলে চলবে কী করে?

অন্যদিকে একটা মিথ্যাতন্ত্র কায়েম করা হলো। ধারণা দেওয়া হলো, আমরা দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরিত হয়ে গেছি। শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি অল্প কিছুদিন কাজ না থাকে তাহলে এখন যে পরিমাণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে, এর দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ টোকা দিলেই পড়ে যাবে, এমন একটা দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। এনার্জি সেক্টরে কাউকে কাউকে টাকা তৈরির জন্য সুযোগ করে দেওযা হয়েছে। যা হওয়ার কথা ছিল সাময়িক ব্যবস্থা, তাকে চিরস্থায়ী করে নেওয়া হয়েছে। এতে রাতারাতি বহু লোক বিরাট টাকাওয়ালা ও বিরাট ব্যবসায়ী বনে গেল। এরা কারা? সবাই এই রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি। এই সেক্টরকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন ‘বৈধভাবে’ই দুর্নীতি করা যায়। এসবের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে একটা ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে গেছে পরিবারতন্ত্র। ব্যাংকগুলোকে একেবারে খারাপ একটা জায়গায় নিয়ে গেছে। আরেকটা বড় কাজ নৈতিকতার অবক্ষয় সৃষ্টি। এটি মানুষের মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এখন মানুষ বলতে পারে—রাজনীতিবিদরা পারলে আমরাও পারি।

এইসবের মধ্য দিয়ে এমন একটা ব্যবস্থার দিকে আমরা চলে গেছি যে মানুষের মানসিকতা বদলে আবার গণতন্ত্রমনা করা বা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির দিকে নিয়ে আসা কঠিন হবে। মানুষ গণতন্ত্র চায়, কিন্তু গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো চর্চা করানোর যে সংস্কৃতি, সেটাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যা হয়েছে তা আমাদের জন্য দুঃখজনক। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই সেনাশাসন চাই না। আমরা চাই, দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বদল হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা চলতে চলতে পরিণত হোক। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ—সব ক্ষেত্রে যে অবক্ষয় আমরা পেলাম, এর জন্য শুধু নির্বাচন না করে ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে যাওয়া দায়ী। পাঁচ বছর পর ক্ষমতার বদল হলে আওয়ামী লীগের জন্যই হয়তো ভালো হতো। অপরাজনীতি করে আওয়ামী লীগ নিজেই তার অস্তিত্ব ধ্বংস করেছে।

আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগের পতনের এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের নয়। ছাত্ররা বেরিয়ে এসেছে, সবাই তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এই আন্দোলন এক ব্যক্তির শাসন চায় না। স্বৈরতন্ত্র চায় না। মানুষ গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা চায় না। এ কারণেই মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে বেরিয়ে এসেছে। এতগুলো প্রাণ আমরা বলি দিয়েছি গণতন্ত্রকে ফেরত আনার জন্য। বুঝতে হবে, এই অন্তর্বর্তী সরকার আগে থেকে পরিকল্পিত কিছু নয়। যার ফলে এরা জানে না কতটুকু কী করতে হবে। এরা কেউ আগে থেকে গুছিয়ে আসেনি। আমাদের চাহিদা গণতন্ত্র, আর কেউ যেন এ রকম স্বৈরতান্ত্রিক হতে না পারে, নির্বাচন যেন সময়মতো হয়। এই চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য কাজ অনেক।

আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারকে মৌলিক সংস্কারের কাজ করে যেতে হবে। এর পরে নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, অনেক রকম সংস্কার তার স্বার্থের অনুকূলে যাবে না। তবু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে স্থায়ী করতে চাইলে কিছু সংস্কারে যেতেই হবে। সংস্কার বাতাস থেকে হবে না। গভীর পাঠের মধ্য দিয়ে সমস্যা বের করে আনতে হবে। সরকার সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। শুরুতেই আমরা দুটি বিতর্ক এমনভাবে সামনে এনেছি যে এটা থেকে ফলাফল বের করে আনা কঠিন হবে। একদিকে আমরা বলছি, যে অন্যায়গুলো ঢোকানো হয়েছে, একেবারে নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গিয়ে আমরা সেগুলোর পরিবর্তন করব এবং সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করব। অন্যদিকে আমরা বলছি, সংবিধানকে কেটেছিঁড়ে এমন করেছে যে এটা বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান তৈরি করব। এই যে দ্বন্দ্বটা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, এটা একদিক থেকে বিপজ্জনক। এতগুলো প্রাণ গেছে, সংস্কারে আমাদের যেতেই হবে। নয়তো কোনো লাভ হবে না। কিন্তু দুটির কোন দিকে যেতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো মতৈক্য নেই। আমাদের একাডেমিকরাও অনেক ক্ষেত্রে এই মতানৈক্য তৈরিতে সহায়তা করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কত দিন থাকা সম্ভব এবং কতটুকু করা সম্ভব, এটুকু চিন্তা করেই বিতর্কটা করা দরকার ছিল। বিতর্কটা এখন একটু ঘোলাটে অবস্থায় আছে। তবে যা-ই হোক, কিছু সংস্কার তো করতেই হবে। যেমন—কোনো দলের কারো নেতৃত্বে পর পর দুইবারের বেশি নির্বাচন হবে না। দুইবারের পর সরে দাঁড়িয়ে দলের অন্য কাউকে নেতৃত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিকভাবে এই নিয়ম করে দিতে হবে যে দলের প্রধান, সংসদের প্রধান এবং সরকারের প্রধান একজন হতে পারবেন না। আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনে মেয়েরা কিভাবে অংশ নিয়েছে। নারীরা এখন এগিয়েছে। সংসদে নারীর জন্য ৫০ আসন সংরক্ষিত থাকুক, এটা আর চাই না। নারীর এখন সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ দরকার। এ জন্য জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ আসনে প্রতিটি দলকে নারী প্রতিনিধি মনোনয়ন দিতে বাধ্য থাকতে হবে। ৫০টি সোনার হারের মতো সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদের আমরা দেখেছি, যে দলের হয়ে তাঁরা আসেন সেই দলের হয়ে কথা বলেন, তাঁদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র মতামত থাকে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেছে, এখন নারী অবলা নয়; নারী শক্তিশালী। নারীকে যে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় না সেই মনোনয়ন চাইবার সময় এখন। এটাই হবে দারুণ সংস্কার।

বিচারিক ক্ষমতা যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে সেটিকে আবার আগের জায়গায় ফেরত নিতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন দরকার। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। আমার ধারণা, যাঁদের হাতে নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁরা এ বিষয়ে অত্যন্ত বিজ্ঞ। আরো যে কমিশনগুলো হয়েছে, সেগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশ যে এক ব্যক্তির শাসনে চলে গিয়েছিল, তার জন্য শুধু ব্যবসায়ীদের না, মিডিয়াকেও দায়ভার নিতে হবে। কোনো মুক্ত-স্বাধীন মিডিয়া আমরা পাইনি।

আমাদের স্বপ্নটা খুব বেশি না। আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার বদল হবে, প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে চলবে, একজনের কাজের ওপর আরেকজন এসে হস্তক্ষেপ করবে না। আমি আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এটুকু আমাদের দিতে পারবে। তবে এগুলো দিতে হলে শক্ত মানুষ প্রয়োজন। আমার মনে হয়, এই সরকারের মধ্যে মধ্যবয়সী লোকজনের একটা অভাব রয়েছে। সরকারে এই ধরনের মানুষকে নিয়ে আসার এখনো সময় আছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ আমাদের ঘটাতেই হবে। আমি আশাবাদী, এই উত্তরণ ঘটবে।

আমার আগামীর প্রত্যাশা হলো, নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেবে, লড়বে, নির্বাচিত হয়ে সগৌরবে সংসদে বসবে। আমরা যে গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেলাম, সেগুলো আমরা জাদুঘর করে করে সংরক্ষণ করব, যেন আগামীতে আর কোনো দিন বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটতে না পারে। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে স্বাধীন মত নিয়ে এগিয়ে যাবে। সেখানে কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না।

লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত) 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।