ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

লোকচৈতন্য জাগরণের নায়ক কবিয়াল রমেশ শীল

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৩
লোকচৈতন্য জাগরণের নায়ক কবিয়াল রমেশ শীল ...

১৮৯৭ সালের কথা। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে জগদ্ধাত্রী পূজায় গান শুনতে গিয়েছিলেন কবিগানপাগল বালক রমেশ শীল।

দুই প্রবীণ কবিয়াল মোহন বাঁশী ও চিন্তাহরণের কবিগানের আসর। আসরে ওঠে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবিয়াল চিন্তাহরণ। বন্ধুরা মিলে আসরে তুলে দিলেন রমেশ শীলকে। ভয়ে কাঁপা পায়ে আসরে উঠলেন তিনি। পরিচয় পর্বে প্রতিপক্ষ প্রবীণ মোহন বাঁশী ‘পুঁচকে ছোড়া, নাপিত...’ বলে অশোভন ভাষায় আক্রমণ শুরু করেন।  

উত্তরে রমেশ শীলের প্রথম পদ ছিল ‘উৎসাহ আর ভয়/ লজ্জাও কম নয়/ কেবা থামাইবে কারে?/ পুঁচকে ছোড়া সত্য মানি/ শিশু ধ্রুব ছিল জ্ঞানী/ চেনা-জানা হোক না এই আসরে...’। শুরু হলো নবীন-প্রবীণের কবিগানের লড়াই। চললো টানা ১৮ ঘণ্টা। শেষে আপসের মাধ্যমে আসর সাঙ্গ হলো। আর ২১ বছর বয়সেই রমেশ ‘কবির সরকার’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
 
এরপর রমেশ শীল কঠোর সাধনা-অধ্যবসায় ও শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জনে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। দারিদ্র্যের শোষিত সন্তান রমেশ শীলের কথা-গান ও সুরে উৎসারিত হয় বাংলার গণমানুষের চালচিত্র। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গান, সুর ও লেখনী ছিল রণতূর্যের মতো। যেমন: ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পরাজয়ের পরে কবিগান বন্ধ হয়ে যায়। রমশে ব্রিটিশ সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কলম ধরলেন। তিনি লিখলেন-‘পাঁচ গজ ধুতি সাত টাকা/দেহ ঢাকা হয়েছে কঠিন/ রমেশ কয় আঁধারে মরি/ পাই না কোরোসিন’। অথবা ‘ব্রিটিশ নিল দেশ লুটিয়া/ উঠছে মোদের চোখ ফুটিয়া/ শোষণ করিস পোষণ ভুলি, তোকে তোষণ করা যাবে না’। ১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুধিরাম বসুর ফাঁসির কাষ্ঠে আত্মদান কবির মানসচিত্ত আন্দোলিত হয়ে ওঠে। তিনি লিখলেন- ‘ধন্য ছেলে মায়ের কোলে/ একা গেলে চলে/ থাকতে ত্রিশ কোটি ভ্রাতা, সঙ্গী ফেলে/একা হল ক্ষুধিরামে ফাঁস’।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা বঙ্গে দুর্ভিক্ষে শত শত লোক মারা যায়। কবিগানের আসর বন্ধ হয়ে যায়। কবিয়ালের দল দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কবি সমিতি গঠন করে। সভাপতি হলেন কবিয়াল রমেশ শীল ও সম্পাদক ছিলেন ফণী বড়ুয়া। চট্টগ্রামের লোকসংগীত রক্ষা ও চট্টগ্রামবাসীর মনে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলার শপথ নেন চাটগাঁইয়া কবিয়ালরা। রমেশ শীল লিখলেন, ‘দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে/এখনও লোক জাগিল না কেনে ?’
 
রমেশ শীলের জন্ম আজ থেকে ১৪৬ বছর আগে। ১৮৭৭ সালে ৯ মে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা পূর্ব গোমদণ্ডীর শীল পাড়ার অতিসাধারণ এক ঘরে তাঁর জন্ম। ১১ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পিতৃহারা হন। তাঁর ওপর নেমে আসে পরিবারের ছয় সদস্যের ভার। জীবিকার তাগিদে গমন করেন বার্মায় (মিয়ানমার)। কিন্তু তাঁর মন-প্রাণে মিশে আছে বাংলার সোঁদা গন্ধ। ১৮ বছর বয়সে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। ফিরে যান পৈতৃক পেশা ক্ষৌরকর্মে। স্বর্ণশিল্পী, মুদি-চালের গুদামে চাকরি, শৈল্য-কবিরাজি-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পাশাপাশি চলে কবিগান ও গণসংস্কৃতি চর্চা।
  
রমেশ শীল আজীবন গেয়েছেন ভুখা-দারিদ্র্র্য, অভাব-ক্লিষ্ট, বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের গান। রাজা-জমিদারদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতেন তিনি। তাঁর লেখাতেই ফুটে ওঠে সেই চিত্র। তিনি লিখলেন ‘একটু দুখের কথা কই মালিক/ দুখের কথা কই, দুখে দুখে জীবন গেল/ সুখ দেখিলাম কই’।
 
১৯৪৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের তৃতীয় সম্মেলনে কবিগান গেয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়াল উপাধি পান। এই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে কলকাতার রাজা ও জমিদারদের পূজামণ্ডপে কবিগানের আমন্ত্রণ আসে তাঁর কাছে। একটি গানের বায়না ছিল পঁচিশ টাকা।  

১৯৪৬ সালে তিনি কবিগান পরিবেশন করেন কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও বঙ্গ বিভাগের পর রমেশ শীল কলকাতায় একাধিকবার কবিগান পরিবেশন করেন। ১৯৪৮ সালে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিগানের পর তাঁকে ‘বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল’ উপাধি দেওয়া হয়, পেয়েছেন একটি পদকও। ১৯৫২ সালেও তিনি কলকাতায় নিখিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে কবিগান পরিবেশন করেন।  

ভারত বিভাগের করুণ পরিণতির পর বঙ্গ বিভাগে কবিগানের আসর যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন রমেশ শীল ছাড়া সমসাময়িক কবি, দোহার ও বাদকেরা স্থায়ীভাবে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। মাটির প্রেমের রয়ে যান তিনি এই বঙ্গে। কবিয়াল-সংকটে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কবিয়ালদের সংগঠিত করে পুনর্গঠন করেন ‘চট্টগ্রাম কবি সমিতি’। এভাবে গ্রাম-বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলেন।
  
১৯২৩ সালে সুফিবাদের সাধন কেন্দ্র মাইজভাণ্ডার শরিফে গেলেন তিনি। সেখানে মানবতাবাদী জীবনাদর্শ তাঁকে আকৃষ্ট করে। একনাগারে সাত বছর মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেছেন তিনি। তাঁর গাওয়া ও রচিত মাইজভাণ্ডারী গান এখনো ভক্ত-অনুরক্তসহ মানুষের মুখে মুখে ফিরে। তিনি গেয়েছেন, ‘মিমের পর্দা উঠাইলে দেখবি ওরে মন/ রাম রহিম কৃষ্ণ করিম মূলেতে একজন’, ‘গাউছুল আজম বাবা নূরে আলম, তুমি ইছমে আজম বাবা/ জগতে তরানে ওয়ালা’, ইস্কুল খুইলাছে রে মাওলা ইস্কুল খুইলাছে...প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি রাঙ্গুনীয়া উপজেলার কাউখালীর সিরাজ শাহ ও পটিয়া উপজেলার সাতগাছিয়ার মৌলানা আবুল খায়ের সুলতানপুরীর প্রতিও অনুরক্ত হন। ১৯৪৮ সালে এক স্বীকারোক্তিতে সাধকপুরুষ জগদানন্দ পুরীর শিষ্য বলে তিনি লিখে যান।  

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই রমেশ শীল ছিলেন সদা সক্রিয়। কবিগানকে তিনি করেছিলেন জাতীয় মুক্তির হাতিয়ার। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনে কবিতা লিখে এক বছর কারাভোগ করতে হয়েছে তাঁকে।  

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে কবিয়াল রমেশ শীলের লেখনি ছিল রণতূর্যের মতো। তিনি কবিতা ও গানে জনগণকে করেছেন উজ্জীবিত। পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জনমত গড়ে তুলেছেন। এজন্য পাক বাহিনী ও এদেশিয় দোসররা তাঁর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর অনেক লেখনি ও সৃষ্টিকর্ম পুড়ে ধ্বংস করে দেয়।  

২০০২ সালে সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। একইসাথে তাঁর দোহার বিনয়বাঁশী জলদাসও এ পদক পান। কবিয়াল সম্রাট-লোককবি রমেশ শীল ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল দেহত্যাগ করেন। বাড়ির পাশে নিজ আখড়ায় তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়।

বাঙালির এই কৃতি সন্তান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। ২০২৩ সালের ৭ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তিনি।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।