ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কমছে খেজুর গাছ, রসের স্বাদ জানে না শিশু-কিশোররা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯
কমছে খেজুর গাছ, রসের স্বাদ জানে না শিশু-কিশোররা

মাদারীপুর: পৌষের গা হিম করা শীত, চারদিকে কুয়াশা। শীতের সকালে খেজুর রসের মিষ্টি ঘ্রাণ। রসের হাঁড়ির টুংটাং শব্দ। বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতিতে এ দৃশ্য যেন এখন কল্পনার খোড়াক!  বর্তমান শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশই জানে না খেজুরের রসের স্বাদ।

গ্রামে এখন শহুরে ছোঁয়া। শহরায়নের আগ্রাসনে প্রকৃতির ঐতিহ্য খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে।

দিন যত যাচ্ছে খেজুর গাছও তত কমছে। গ্রামের রাস্তায় মাঝে মধ্যে দু’একটা গাছ চোখে পড়ে। এসব গাছের কোনো কোনোটা কেটে রস নামানো হয়। আবার অনেক গাছ কাটাও হয় না। বর্তমানে গাছ কাটার লোকেরও অভাব দেখা দিয়েছে। এমনটাই জানান স্থানীয়রা।  

একটা সময় মাদারীপুরের খেজুর গুড় ঐতিহ্যবাহী ছিল। গাছের সংকটে তেমন রস না পাওয়ায় সেই ঐতিহ্যও হারাচ্ছে দিন দিন। খেজুর গুড়ের পায়েস-পিঠায় আসল স্বাদ আনতে এ অঞ্চলের খেজুর গুড়ও এক সময় ছিল অতুলনীয়।

সরেজমিনে জেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো জায়গায় কিছু কিছু খেজুর গাছ রয়েছে। যে সব স্থানে এক সময় রাস্তার দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য খেজুর গাছ ছিল সেই সব স্থানে এখন নেই খেজুর গাছ। গ্রামের কোনো কোনো সড়কের পাশে কিছু গাছ থাকলেও তাতে তেমন রস হয় না বলে স্থানীয়রা জানান।

জানা গেছে, শীতের শুরুতেই রস সংগ্রহের জন্য কাটা হয় খেজুর গাছ। গাছের অগ্রভাগের একপাশে বেশ খানিকটা কেটে পরিষ্কার করা হয়। পরে বাঁশের কঞ্চি কেটে কাঠি তৈরি করে গেঁথে দেওয়া হয়। তার ঠিক নিচেই ঝোলানো হয় মাটির হাঁড়ি। গাছের কাটা অংশ বেয়ে রস কাঠির মাধ্যমে ফোঁটায় ফোঁটায় হাঁড়িতে এসে জমা হয়। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ আর কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। এ সময়ে প্রাপ্ত রসের স্বাদও ভালো থাকে। পাঁচ বছর বয়স থেকে খেজুর গাছে রস পাওয়া যায়।

রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুর এলাকার কাশেম মিয়া নামে এক ব্যক্তি জানান, এক সময় শীত মৌসুমে তার প্রধান কাজ ছিল খেজুর গাছ কেটে রস নামানো আর গুড় তৈরি করা। এছাড়াও তার বাড়িতে খেজুর রস কিনতে একদিন আগেও বায়না দিয়ে যেতো অনেকে। খাঁটি খেজুর গুড়ের ঘ্রাণ থাকতো পুরো শীত মৌসুম। এখন আর খেজুর গাছ নেই তেমন। আর যা আছে তাতে রসও পড়ে অল্প। কেউ কাঁচা রসও এখন আর খায় না। ’

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খেজুর রসে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি থাকতে পারে এমনটা ভেবে কেউ এখন আর কাঁচা রস শখ করেও খায় না। তাছাড়া খুব একটা পাওয়াও যায় না।

ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসা একটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, যখন তারা ছোট ছিলেন তখন শীতের সকাল মানেই খেজুরের রস খাওয়া। আর এখনকার বাচ্চারা খেজুর রসের স্বাদ কেমন তাই জানে না। খেজুর গাছ দিন দিন কমে যাওয়ায় রসও পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তাছাড়া খেজুর রসে নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকি রয়েছে। ’

মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, এক সময়ে সড়কের পাশ দিয়ে থাকা খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। গ্রামীণ সড়কের সংস্কার কাজের কবলে পরেও অনেক স্থানের খেজুর গাছ উজার হয়ে গেছে। এছাড়াও একটা সময়ে ইটের ভাটায় অবাধে গাছ পোড়ানোর প্রবণতা ছিল।

আলাপকালে অনেকেই জানান, বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে খেজুর গাছ বিক্রি করে দেয় অনেকেই। অথচ এরপর আর খেজুর গাছ লাগানো হয়নি। ফলে এভাবেই দিন দিন কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা। ফলে খেজুর গুড়ও এখন আর তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছে না।

মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার শ্রীকৃষ্ণদি এলাকার গাছি (খেজুর গাছ যারা কাটেন) রাজ্জেক মিয়া জানান, ‘পান্তাপাড়া-শ্রীকৃষ্ণদি এলাকার রাস্তার পাশ দিয়ে ১০/১২ বছর আগেও অসংখ্য খেজুরের গাছ ছিল। এখন আর খেজুরের গাছ তেমন দেখা যায় না। কারণ অনেক গাছ বিক্রি এবং কিছু গাছ মরেও গেছে। সে সময় প্রতিদিন সকালে হাঁড়ি ভরে রস আনতাম। বাড়িতেই মিঠাই তৈরি করতাম। তারপর এলাকার বাজারে সেই মিঠাই বিক্রি করা হতো।

তিনি আরও বলেন,‘এখন আর আগের মতোন রস পড়ে না। তাছাড়া বাদুরের বেশ উৎপাত। অনেক গাছই এখন আর কাটা হয় না। রস তেমন না পড়ায় আমাদের আগ্রহও কমে গেছে। এক সময় শীত মৌসুমে আমাদের আয়ের পুরোটাই আসতো খেজুর গুড় তৈরিতে। এখন সেইটা নাই। ’

তারপরও জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো টিকে আছে মলিন কিছু খেজুর গাছ। আর তার উপরই নির্ভর করে টিকে আছে খেজুর গুড়ের উৎপাদন। ভেজাল গুড় তৈরি হলেও খাঁটি গুড়ও পাওয়া যাচ্ছে কোনো কোনো গ্রামীণ বাজারে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।