ঢাকা: বড় কলেবরের কয়েকটি দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে বিদায়ী বছরে নানা আলোচনা আর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুর্নীতির অভিযোগ থেকে কয়েকজন পলিটিক্যাল হেভিওয়েটকে অব্যাহতি দেওয়ায় বিএনপি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সহ বিভিন্ন মহল থেকে দুদকের গায়ে লাগানো হয়েছে ‘দায়মুক্তি কমিশন’ এর তকমা।
তবে এমন সমালোচনার সোজাসাফটা জবাবও দিয়েছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন তা ধারণা থেকে আর দুদক চলে দালিলিক প্রমাণাদিতে।
বিতর্ক যাই চলুক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ২০১৪ সাল দুদকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। বিদায়ী বছরটিকে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো: সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সফলতার বছর হিসেবেই দেখছেন। বিদায়ী বছরটিতে পদ্মাসেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগটি তদন্ত করে ভুল প্রমাণিত করাই তার দৃষ্টিতে দুদকের বড় সফলতা।
বাংলানিউজকে দুদকের অন্যতম প্রধান এ কর্মকর্তা বলেন, পদ্মাসেতু শুরু হওয়ার আগেই যারা এর গায়ে দুর্নীতির কালিমা লেপন করে পুরো বাংলাদেশকেই বিতর্কিত করতে চেয়েছিলেন ২০১৪ সালে দুদকের তদন্তে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বছরটিতেই দুদকই প্রমাণ করেছে পদ্মাসেতুতে কোনো ধরণের দুর্নীতি হয়নি।
তবে এর বাইরে আরও সফলতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতি করে যারা দেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। মহাজোট সরকারের যেসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ ও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
সামগ্রিকভাবে বিদায়ী বছরটিকে সফলতার বছর হিসেবেই দেখছেন দুদকের দায়িত্বশীল এ কর্মকর্তা।
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, চলতি বছরের শুরুতে বিগত মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান কয়েকজন সংসদ সদস্যের অবৈধ সম্পদের অভিযোগে যে অনুসন্ধান দুদক শুরু করেছিল, তা ব্যাপক আশার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু শেষদিকে এসে এদের কয়েকজনকে দায়মুক্তি দিয়ে কমিশন তার ভুমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সর্বশেষ একজন সংসদ সদস্যের (রাজশাহীর এমপি এনামুল হক) বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে কমিশনারদের মধ্যে মতানৈক্য ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বছর শেষে দুদকের সফলতা ব্যর্থতা মূল্যায়ন করলে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি হবে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিদায়ী বছরে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়েছে দুদক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপের মধ্যে থেকে কাজ করেছে। দুদক অবশ্য বরাবরই এমন চাপে থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অতি সম্প্রতি দুদকের একজন কমিশনার টিআইবির বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দেখে মনে হয়নি এটি প্রতিষ্ঠানটির একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্য। ওই কমিশনারের বক্তব্যটিকে রাজনৈতিক বক্তব্য বলেই মনে হয়েছে।
ফ্ল্যাশব্যাক ২০১৪
সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী আমলাদের কারো বিরুদ্ধে মামলা করা আবার কাউকে অব্যাহতি দেওয়ায় আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুদক। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণও ছিলো বছরজুড়ে আলোচিত বিষয়।
এমপির কারাবরণ, অন্যদের অব্যাহতি
গত ২১ আগস্ট সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সাংসদ আবদুর রহমান বদির নামে দুদক মামলা করে দুদক। এর মধ্যে কক্সবাজারের এমপি বদিকে দুদকের মামলায় কারাবরণও করতে হয়েছে।
অপরদিকে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ এনে দুদক অনুসন্ধান করলেও গত ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ মো. আসলামুল হক, গত ৮ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রী ও সাতক্ষীরা-৩ আসনের সাংসদ রুহুল হক এবং ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ এবিএম এনামুল হককে ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ নেই’ মর্মে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়।
মুখোমুখি দুদক-টিআইবি
দুদক দুর্নীতিবিরোধী একটি রাষ্ট্রীয় তদন্ত সংস্থা। টিআইবি দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা। বছরজুড়ে এ দুটি প্রতিষ্ঠান পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে ছিলো। গত ২৮ মে এক অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু টিআইবি’র মুখোশ উন্মোচন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়ে বেশকিছু তীর্যক কথাবার্তা বলেন। পরদিন এক অনুষ্ঠানে এর জবাব দেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আমাদের কোনো মুখোশ নেই, মুখ আছে। পরিচয় একটাই আমরা টিআইবি।
দুদক কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু টিআইবি’র আয়-ব্যয়ের উৎস খুঁজে দেখা হবে বলে যে ঘোষণা দেন, তার জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের অনুমোদনের বাইরে টিআইবি কোনো অর্থ গ্রহণ করতে পারে না, ব্যয়ও করতে পরে না।
বছরের শেষদিকেও গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘সম্প্রতি টিআইবি গ্লোবাল কনসেপ্টে দুর্নীতি বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। টিআইবি এখান থেকে যা পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে তাই প্রকাশ হয়েছে। হেড কোয়ার্টারে (টিআই) যা পাঠানো হয়েছে, তা প্রকৃত চিত্রের বিপরীত। ’
তিনি টিআইবিকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ উল্লেখ করে বলেন, একটি বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে টিআইবি কাজ করছে।
তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তার বক্তব্যটি অবান্তর। টিআইবি কোনো মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে না। আমাদের লক্ষ্য দুর্নীতি দমনে কাজ করা। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
৫ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা-সনদ বাতিল
বিদায়ী বছরে ছয় সচিবের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির বিষয় অনুসন্ধান শেষে গত ২৮ আগস্ট কমিশনে দাখিল করা প্রতিবেদনে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরা হলেন-বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদার, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সচিব নিয়াজউদ্দিন মিঞা ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব একেএম আমির হোসেন।
দুদকের জালে বিএনপি নেতারা
চলতি বছর বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও তার প্রবাসী ভাই মঞ্জুর আহমদের বিরুদ্ধে গুলশানে বাড়ি দখলের অভিযোগে মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুদকের মামলায় জেলে রয়েছেন। সাদেক হোসেন খোকা, জমির উদ্দিন সরকার, এম মোর্শেদ খান, মোসাদ্দেক আলী, এহছানুল হক মিলন, আলমগীর কবির, এ কে এম মোশাররফ হোসেন, আলী আসগার ও তার পরিবারের সদস্যরা এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, তারেক রহমানের শাশুড়ি আরজুমান্দ বানু, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিরুদ্ধেও দুদকের মামলা চলছে।
এছাড়া ডেসটিনির অর্থ পাচার ও সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখার ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় চার্জশিট, আনন্দ শিপইয়ার্ড ঋণ জালিয়াতি এবং সুইস ব্যাংকে আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকা, মুক্তিযুদ্ধের ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতিসহ বছরজুড়ে অনেক আলোচিত বিষয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪