ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনায় বেপরোয়া অপরাধী চক্র, জনমনে উদ্বেগ

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
খুলনায় বেপরোয়া অপরাধী চক্র, জনমনে উদ্বেগ

খুলনা: খুলনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। প্রায় প্রতি রাতে কোথাও না কোথাও চলছে সন্ত্রাসীদের মহড়া।

রাতের অন্ধকার নামতেই নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে-বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধীচক্র। প্রকাশ্যে গুলি করে কিংবা কুপিয়ে জখম বা হত্যার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা।

স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ও জনসাধারণের। একের পর এক ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও। এসব ঘটনায় হচ্ছে মামলা। কিছু কিছু মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও কমছে না হত্যাকাণ্ড।

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ দিন কারাগারে থাকা অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ৫ আগস্টের পর জামিনে বেরিয়ে এলাকার নতুন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

আলোচিত কিছু ঘটনা
খুলনার হাজী মুহসীন রোডে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে মো. সোহেল (৩২) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তিনি সাতক্ষীরার আমুলিয়া রাজাপুরের বাসিন্দা খালেক কারিগরের ছেলে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে খুলনার মহানগরীর বাবুখান রোড দ্বিতীয় গলির বাসিন্দা রঙ মিস্ত্রী মো. সোহেলকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে। পিঠের ডানপাশে গুলি লেগে পেটের বাম সাইড থেকে বের হয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন সিটি মেডিকেলে আনার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর আগে খুলনায় সন্ত্রাসীর গুলিতে আকাশ নামের এক যুবক আহত হয়। ১৩ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর মিয়াপাড়া বন্ধনের মোড়ে এই ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ আকাশ নগরীর পূর্ব বানিয়াখামার চৌধুরী গলির মৃত হাফিজুল ইসলামের ছেলে।

তার আগের দিন ১২ ডিসেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে জিরোপয়েন্ট এলাকার মেসার্স সিকদার ফিলিং স্টেশনের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রেজা শেখ (৩৫) নামে এক যুবকের পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সন্ত্রাসীরা। আহত রেজা শেখ লবণচরা থানাধীন কৃষ্ণনগর এলাকার সুলতান শেখের ছেলে।

৬ ডিসেম্বর বিকেলে রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইমরান হোসেন মানিক নামে এক যুবক আহত হন।

৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে নগরীর নিরালা এলাকায় ১০-১৫টি মোটরসাইকেলে এসে একদল সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে পথচারী ইউনুস শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এরপর সন্ত্রাসীরা চাঁনমারি এলাকায় গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এছাড়া ওই এলাকার আব্দুল আহাদ হাওলাদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে।

গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সবজি বিক্রেতা নাঈম সানা গুলিবিদ্ধ হন।

গত ২৯ নভেম্বর রাতে নগরীর টুটপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন মোল্লা বোয়িংকে গুরুতর আহত করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আশিক বাহিনীর প্রধান আশিক, তার ভাই সজীবসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে খুলনা সদর থানায় মামলা করেন আমিনের ছোট ভাই মো. আবদুল্লাহ।

শত শত মানুষের সামনে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ত্রাস সৃষ্টি করে কুপিয়ে চলে গেল, কিন্তু কেউ কিছু করতে পারলো না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বজনরা।

এর আগে নগরীর বসুপাড়া এলাকায় গত ৫ নভেম্বর রাতে অস্ত্রধারীরা রফিকুল ইসলাম মুক্তা নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে।

২ নভেম্বর রাতে নগরীর আলকাতরা মিল এলাকায় সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে পঙ্গু রাসেল নামে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করে। এ সময় সজীব ও ইয়াসিন নামে দুই যুবককে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। একই রাতে নগরীর বাবু খান রোডে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রহমান বেলালকে আহত করে।

গত ২৮ অক্টোবর দুপুরে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নগরীর দৌলতপুর থানার কালীবাড়ি বাজারের দত্ত জুয়েলার্সে ডাকাতি করে। তারা জুয়েলার্স থেকে স্বর্ণালংকার ও নগদ দুই লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়।

গত ২১ অক্টোবর রাতে কয়রা উপজেলার কাটাখালী গ্রামে পুলিশের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা অপহরণ মামলার আসামি হারুন গাজীকে ছিনিয়ে নেয়। তাদের হামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।

উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ
খুলনায় অপরাধের এমন বাড়বাড়ন্তে উদ্বেগ জানিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীর দোসররা খোলস বদলে তাদের সেই পূর্বের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আগে কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশের যে তৎপরতা বা অভিযান থাকতো, তাও বর্তমানে ঝিমিয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মো. বাবুল হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা এখন আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে। রাত হলেই অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় গোটা নগরী। যে কারণে প্রায়ই ঘটছে খুনের মত নৃশংস ঘটনা। ছাত্র-জনতার বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে গত জুলাইয়ে স্বৈরাচার সরকারেরপতন করা হয়েছে, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের কারণে শান্তিশৃঙ্খলার পরিবর্তে খুলনা এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। আশা করব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হবে। কঠোর নজরদারি করে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে। সর্বোপরি জনমনে স্বস্তি ফিরাতে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরও সক্রিয় হতে হবে।

যা বলছে পুলিশ
খুলনায় অপরাধ প্রবণতা বাড়া প্রসঙ্গে মহানগর পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্‌) আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ্ বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন পয়েন্টে চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। হঠাৎ করেও আমরা অনেক স্থানে চেকপোস্ট বসাচ্ছি। রাতে যেসব খুন হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি, কিছু আসামিও গ্রেপ্তার হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি অপরাধ দমন করার জন্য।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
এমআরএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।