ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা লিয়াকত হোসেন লিটন। গুলিটি পেট দিয়ে ঢুকে কোমর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
আর এই শারীরিক পরিস্থিতি নিয়েই চাকরি করছেন লিটন। কারণ,একদিকে সংসারে আর্থিক অনটন অন্যদিকে তার চিকিৎসার জন্য মা ঋণগ্রস্ত এখন।
সেই ঋণের বোঝা কমাতে পরিপূর্ণ সুস্থ না হয়েই রাজধানীর মৌচাকে আনারকলি মার্কেটে একটি দোকানে চাকরি নিয়েছেন লিটন।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত লিটনের চিকিৎসায় লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সরকারি সহযোগিতার টাকার পেছনে ছুটতে গিয়েও হাজার হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার মায়ের। তবুও সেই সহযোগিতার টাকা এখন পর্যন্ত পাননি লিটন। অবশ্য এখন পর্যন্ত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এ যোগাযোগ করা হয়নি তাদের।
শুক্রবার (১৪ ডিসেম্বর) পশ্চিম রামপুরা ওয়াপদা রোডের একটি ভাড়া করা বাসায় গিয়ে কথা হয় লিটনের সঙ্গে। সেই বাসায় বড় ভাই ও মায়ের সঙ্গে থাকেন লিটন। বাসার সামনে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লিটন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে গেটটি খুলে দিল।
হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে কেন প্রশ্ন করতেই লিটন বললেন, গুলির আঘাতে একটি পা জোরালোভাবে মাটিতে চাপ দিয়ে হাঁটতে পারি না।
হাসপাতালে ভর্তি হতে বললে লিটনের উত্তর, আর কত হাসপাতালে ভর্তি থাকব! আমার চিকিৎসা করাতে গিয়ে মা অনেক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সেই ঋণ শোধ করতে চাকরি নিয়েছি।
কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন তা জানাতে লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ডাকে গত ১৯ জুলাই সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে রামপুরা টিভি সেন্টার সড়ক টিভি রোডের মুখে আমরা বেশ কয়েকজন অবস্থান নিই। এ সময় হঠাৎ রামপুরা টিভি সেন্টার থেকে বিজিবির পোশাক পরা কিছু লোকজন বেরিয়েই আমাদের দিকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। তখন একটা গুলি আমার নাভির পাশ দিয়ে ঢুকে পিঠের নিচে কোমর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
লিটনের স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের ঘটনা। গুলিতে আহত হওয়ার পরে মাটিতে পড়ে যান তিনি। নিজে নিজে ওঠার চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারছিলেন না। এ সময় হঠাৎ দেখতে পান তার পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে পাশের ড্রেনে পড়ছে। তখন কিছুটা আঁচ করতে পারেন, তিনি গুলিবিদ্ধ। এ সময় লোকজন তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা গজ-ব্যান্ডেজ দিয়ে কোনোমতে পেটের রক্তটা বন্ধ করে তাকে মুগদা হাসপাতালে নিতে বলেন। এরইমধ্যে তার কাছ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে এক নার্স ফোন দেন লিটনের পরিবারকে। তার পরিবার বেটার লাইফ হাসপাতালে গিয়ে লিটনকে নিয়ে যায় মুগদা হাসপাতালে। সেখানেও কোনো চিকিৎসা না পেয়ে লিটনকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের পরামর্শে রক্ত ম্যানেজ করা হয়। পাঁচ ব্যাগ রক্তের মধ্যে দুই ব্যাগ হাসপাতাল থেকে কিনতে লাগে ক্রস ম্যাচিংসহ তাদের আনুমানিক ৫ হাজার টাকা। তারপর বিভিন্ন লোকজন তাদের রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেন। এরই মধ্যেই লিটনের অস্ত্রোপচার হয়। পরে লিটনের অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পুরাতন ভবনের তৃতীয় তলায় তাকে নেওয়া হয় নিবিড় পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ড আইসিইউতে।
সেখানে টানা ৯দিন চিকিৎসা থাকার পরে ওই ভবনের নিচতলা ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের ৩ নম্বর বেডে নেওয়া হয়। ওয়ার্ডে দু-একদিন থাকার পর তাকে ছাড়পত্র দেন চিকিৎসকরা। ৩১ জুলাই হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় লিটনকে। বাসায় থাকা অবস্থায় আবারও লিটন অসুস্থ হয়ে পড়লে ৫ সেপ্টেম্বর ঢামেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহতদের চিকিৎসার জন্য বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় ভর্তি করা হয়। সেখানেও ২৮ দিন চিকিৎসা থাকার পরে আবারও তাকে ছাড়পত্র দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এবার লিটনের পেটের ক্ষত জায়গায় ধীরে ধীরে শুকাতে থাকলেও তার ডান পায়ের অবস্থা করুন হতে থাকে। মাটিতে জোরালোভাবে চাপ দিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছেন না লিটন।
এই অবস্থায় সংসারের অভাব-অনটন তার চিকিৎসার পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ। ধারকর্জ করে এসব টাকার জোগাড় করেছেন লিটনের মা হনুফা বেগম। পাশাপাশি তার দুই বিবাহিত বোন কিছু সহযোগিতা করেছেন।
কিন্তু আর পেরে উঠছেন না লিটনের মা। ঋণের সাগরে মাকে ডুবে যেতে দেখে শরীরের এই অবস্থা নিয়েই লিটন প্রস্তুত হতে থাকে চাকরির জন্য। পেয়েও যান আনারকলি মার্কেটের একটি দোকানে।
লিটনের একটাই কথা, আমার জীবনটা নিয়ে আমি এখন আর ভাবি না। আমার পরিবার, আমার মা আল্লাহর হুকুমে অনেক কষ্ট করে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। আমার চিকিৎসার জন্য অনেক ঋণগ্রস্ত মা। সেই ঋণ শোধ করতে হবে।
লিটনের আক্ষেপ, সরকারি সহযোগিতার কথা শুধু ঘোষণায় শুনলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না। আমার মা বিভিন্ন জায়গায় কাগজপত্র নিয়ে ঘুরেছেন, যে যেখানে যেতে বলেছেন সব জায়গায় গেছেন। সরকারিভাবে সহযোগিতার আশায় গত সাড়ে ৩ মাসে মা আসা-যাওয়াসহ কয়েক হাজার টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু সরকারি কোনো সহযোগিতা এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি।
সহযোগিতা না পাওয়ার কারণ জানাতে লিটন বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকিটের ওপরে আমার ডাকনাম লিখেছে লিটন। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার নাম লিয়াকত হোসেন। এখন লোকজন বলছে, এই নাম সংশোধন করে কাগজ জমা দিতে হবে। অনেকবার এই সংশোধনের কাগজ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু সবাই বলে ঠিক হয়ে যাবে। আজ না, কাল করতে করতে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেউ সংশোধন করে দিতে পারেনি।
লিটন বলেন, আগে তো এসব কথা চিন্তা করে কখনোই আন্দোলনে যাইনি। সারা দেশের মানুষ যখন আন্দোলন করছিল আমিও সেই দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। জীবনের মায়া করি নাই। যখন আন্দোলনে গিয়েছিলাম তখন তো কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র দেখতে চায়নি, ডাক নাম কি, বাবার নাম কি এসব তো কেউ জানতে চায়নি। এখন কেন জানতে চাচ্ছে?
লিটনের মা হনুফা বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রশাসনিক ব্লকে কাগজপত্র নিয়ে অনেকবার গিয়েছি, তারা বলেছেন ঠিক হয়ে যাবে। একবার বলে অমুক রুমে যান। আরেকবার বলে সেই রুমে যান, সব জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। তবে এর মধ্যে এক-দুইবার ফোন দিয়েছিল, কে বা কারা আমাদের বিকাশ নাম্বার নিয়েছে। কিন্তু এই নম্বর নেওয়া পর্যন্তই শেষ। এখন পর্যন্ত আর কেউ যোগাযোগ করেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করতে পারিনি। কারণ, হাসপাতাল থেকে অনেকেই বলেছে আপনার ছেলের টিকিটে এক নাম আর জাতীয় পরিচয়পত্রে আরেক নাম। সেটা সংশোধন ছাড়া ওখানে গিয়ে লাভ নেই।
লিটনের সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি পরিচালক ডা. আব্দুর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে আহত অনেকে ডাকনাম দিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে আরেক নাম। এটা কোনো সমস্যাই না। আমরা এটা সংশোধন করে দিচ্ছি। তবে যে ওয়ার্ড থেকে যেই চিকিৎসক রোগীদের ছাড়পত্র দিয়েছেন সেই ওয়ার্ডে গিয়ে সংশোধন করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। কারণ, ওই সময় রোগীদের যিনি ছাড়পত্র দিয়েছিলেন সেই চিকিৎসককে পেতে একটু সমস্যা হচ্ছে।
এরপর তিনি বলেন, এরকম যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে লিটন নামের ওই রোগীকে পাঠিয়ে দিন, সমাধান করে দেব।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
এসএএইচ