ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ পৌষ ১৪৩১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

মেট্রোরেলের কোথাও খাওয়ার পানি নেই, বোতলে নিষেধাজ্ঞা

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২৩
মেট্রোরেলের কোথাও খাওয়ার পানি নেই, বোতলে নিষেধাজ্ঞা

ঢাকা: অনবরত সমস্যা লেগেই আছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনা। নানা সময় নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে স্টেশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এসেছে দেশের গণমাধ্যমে।

সম্প্রতি সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া যায় মেট্রোরেলে দায়িত্বরত এক আনসার সদস্যের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া ঘটে ভাংতি টাকা ছাড়া টিকিট না দেওয়া, টয়লেট ইজারা, প্রতিবন্ধীদের জন্যে যথাযথ সেবা নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতা ইত্যাদি।

নতুন করে যে অব্যবস্থাপনার কথা জানা গেছে, সেটি মেট্রোরেলের স্টেশনে ‘পানীয় জলের অভাব’ সম্পর্কিত। তা ছাড়া মেট্রোরেলের সময় বৃদ্ধিতে যাত্রীদের দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও অনেক বড় অভিযোগ। যদিও এ রেল চলে দৈনিক ১২ ঘণ্টা; সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

যে সমস্যাগুলো ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সেসব বিষয়ে বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ‘বিষয়গুলো সাময়িক ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টির কারণে হয়েছে। ’

জানা গেছে, মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত চালু হওয়া ৯ রুটের কোথাও পানীয় জলের সুব্যবস্থা নেই। এতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যাত্রী এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগও দিয়েছে। কিন্তু স্টেশনে বোতলে করে তরল জাতীয় পদার্থ নেওয়া নিষেধ। সেক্ষেত্রে পানীয় বহন নিয়ে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (জিএম) ইফতিখার হোসেন।

পানি যদি নিতে না-ই পারে জরুরি মুহূর্তে যাত্রীরা কী করবে? তা ছাড়া ট্রেনের ভেতর কোনো যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার যদি পানি প্রয়োজন হয়- সে ক্ষেত্রে কী করা যাবে? সর্বপোরি, স্টেশনের অভ্যন্তরে না রেখে পানির ব্যবস্থা যদি বাইরের দিকে করা হয় (ফিল্টার সিস্টেম) এতে কোনো অসুবিধা হবে কি না?

এসব প্রশ্নের উত্তরে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তাদের সেবা দেওয়া হবে। আমাদের এইড ব্যবস্থা রয়েছে রেলে। সেগুলো ব্যবহার করা হবে। তা ছাড়া পানির ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। আমরা আমাদের পলিসি অনুসরণ করেই চলছি।

ভাংতি টাকা ছাড়া টিকিট না যাত্রীদের হয়রানি করার বিষয়টি প্রকাশ পায় গত ২৬ আগস্ট। এদিন বিকেল পাঁচটায় আগারগাঁও স্টেশন থেকে টিকিট নিতে যান নাজিবুর রহমান নাঈম নামে একটি যাত্রী। কাউন্টারে তিনি ২০০ টাকার একটি নোট দেন। কিন্তু তাকে বলা হয় ভাংতি দিতে। কিন্তু নাঈমের কাছে মাত্র ১৭ টাকা ভাংতি ছিল। এ কথা শুনে কাউন্টার থেকে তাকে টিকিট দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।

নাঈম জানান, ঘটনাটি ঘটলে তিনি ভিডিও করতে শুরু করেন। কারণ, কাউন্টারে অনেক ভাংতি টাকা থাকলেও ইচ্ছে করেই তাকে টিকিট দেওয়া হচ্ছিল না। এসময় অন্য যাত্রীরাও তাকে টিকিট দিতে বললে কাউন্টারের দ্বায়িত্বরত কর্মী জায়গা ছেড়ে চলে যান। কিছুক্ষণ পরে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে আসেন। ওই পুলিশ সদস্য নাঈমের মোবাইল নিয়ে যেতে চান। এ সময় অন্যান্য যাত্রীরা প্রতিবাদ শুরু করে চলে যান তিনি। এসব ঘটনা ঘটার পরও টিকিট পাননি নাঈম। পরে স্টেশনের অভিযোগ খাতায় নিজের সমস্যার কথাগুলো প্রকাশ করে আসেন তিনি।

এ বিষয়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ভিন্ন। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সাধারণ ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, বিষয়টি এক পাক্ষিক হয়ে গেছে। কাউন্টার থেকে যাত্রীকে বলা হয়েছিল অপেক্ষা করতে। কারণ, ২০ টাকার জন্য তাকে ভাংতি দিলে তা শেষ হয়ে যাবে। ওই যাত্রী সেটি না করে ভিডিও করা শুরু করেন। এছাড়া ওখানে বলাও আছে ২০ টাকার টিকিটের জন্য ভাংতি রাখতে।

২০ টাকার টিকিটের জন্য একজনকে দুইশ টাকা ভাংতি করে দিলে কী খুব বেশি সমস্যা হতো কিনা- এ প্রশ্ন প্রায় সব যাত্রীদের। কিন্তু মেট্রো কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো উত্তর দেয়নি। তবে বলেছে, টাকা ভাংতির বিষয়টি তারা তদন্ত করছে।

২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর চালু হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত যাত্রী বেড়েছে মেট্রোরেলের। সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত এ পরিবহনের সার্ভিস চালু থাকলেও সময়ের আগে-পরের যাত্রীরা সুবিধাবঞ্চিত। সাধারণত যেসব স্কুল-কলেজ সকাল ৭ বা ৮টা থেকে শুরু হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেট্রোরেলের সুবিধা নিতে পারছে না।

আবার রাতে যাদের অফিস (কল সেন্টার, আন্তর্জাতিক কোনো কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি) তারাও মেট্রো সুবিধা থেকে দূরে। তাই যাত্রীরা রেলের সময় বাড়াতে দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সেটি মানা করে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে মেট্রো কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, আপাতত সময় বাড়ানো যাচ্ছে না।

মেট্রোরেল জিএম ইফতিখার হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আগামী ২০ অক্টোবরের পর চিন্তা করা যাবে। আপাতত ট্রায়াল রান চলছে।

অভিযোগ আছে স্টেশনের লিফট সুবিধা নিয়েও। প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের চলাচলের জন্য মেট্রো স্টেশনগুলোয় লিফট সুবিধা থাকলেও সেটি ব্যবহার করছেন সকলে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়। যেখানে দেখা যাচ্ছে, হুইল চেয়ারে এক ব্যক্তি বসে আছেন। তার অসহায় দৃষ্টি মেট্রোর লিফটে। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষগুলো তাকে ফেলে ওই লিফটে চড়ছেন।

যে লিফট নিয়ে এত কথা, সেটিতে কিন্তু সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে বলা আছে- কারা কারা মেট্রো স্টেশনের লিফটে চড়তে পারবেন। ডিএমটিসিএল’র সাধারণ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সব জায়গায় তো লোক রাখা যায় না। মানুষ সচেতন হলে এ সমস্যাটা হতো না।

এর আগে বাংলানিউজে ‘মেট্রোরেলের টয়লেট ইজারায়, টিকিট ১০ টাকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে অধিকতর সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে দুই সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন মেট্রোস্টেশনে দায়িত্বরত এক আনসার সদস্যের কাছে। ঘটনাটি ঘটে গত ২৯ আগস্ট, আগারগাঁও স্টেশনে।

ঘটনার শিকার হন দৈনিক সমকালের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার মামুন সোহাগ ও দৈনিক আমাদের সময়ের আক্তারুজ্জামান। তাদের কাছ থেকে বুম কেড়ে নিয়ে লাঞ্ছিত করা আনসার সদস্যের নাম আছলাম সরদার।

মেট্রোরেলে ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে যাত্রীদের ক্ষোভ আগে থেকেই। এর মধ্যে বৈশাখী সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে স্টেশনের টয়লেট ইজারা দেওয়া- সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। বৈশাখী সিকিউরিটি যাত্রীদের টয়লেট সুবিধা দিয়ে ১০ টাকা করে টিকিট ধরিয়ে দিচ্ছে। আগারগাঁও, মিরপুর-১০ একাধিক স্টেশনে ‘টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ’ তুলতে দশ টাকার টিকিট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বৈশাখী সিকিউরিটি সার্ভিসেস।

যাত্রীরা বলছেন, মেট্রোরেলে এমনিতেই ভাড়া অনেক বেশি। অথচ যাত্রীদের ওয়াশরুম ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা তারা করছে না। কর্তৃপক্ষের সেবা দেওয়ার চিন্তা কম; মুনাফা প্রবণতা বেশি।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল’র কর্মকর্তা ইফতিখার হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, আমাদের স্টোর অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট বিভাগ একটা চুক্তি করে ইজারা দিয়েছে। এটা বৈধ। চুক্তি অনুযায়ী এটা হয়েছে।

দুই সাংবাদিক লাঞ্ছিত ও তাদের বুম কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলনে, ওই আনসার সদস্যের বিষয়ে তদন্ত চলছে। সাংবাদিকদের ওপরও দোষ চাপান ইফতিখার। বলেন, মেট্রোরেলে গিয়ে ছবি বা ভিডিও ধারণ রার আগে অনুমতি নেওয়া দরকার। ওই দুই সাংবাদিক তা করেননি।

সামগ্রিক ব্যাপারে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি আশীষ কুমার দে বাংলানিউজকে বলেন, পানীয় জলের সুব্যবস্থা নেই- এটা মেট্রো কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তা ছাড়া ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য ১০ টাকা নেওয়া অনৈতিক। এরমধ্যে আবার এ রেলের টিকিটের দামও বেশি। তাই মেট্রো কর্তৃপক্ষ যদি নিজেরাই পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থাপনা করত, যাত্রীদের পাশাপাশি তাদের জন্যও কল্যাণকর হতো।

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
এনবি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।