ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

বেগমগঞ্জ: এএসপি-ওসির বিষয়ে ব্যবস্থা চায় তদন্ত কমিটি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২০
বেগমগঞ্জ: এএসপি-ওসির বিষয়ে ব্যবস্থা চায় তদন্ত কমিটি

ঢাকা: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় চৌকিদারের বিষয়ে আদালত যৌক্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিতে পারে বলে মত দিয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি।

পাশাপাশি ওই ঘটনায় ভিকটিমের স্বামীর নীরবতা কিংবা বিচার না চাওয়ার ঘটনাকে সন্দেহজনক বলে মনে করে কমিটি।

এ জন্য তাকে আইনের আওতায় এনে বিষয়টি যাচাই করা যেতে পারে। এছাড়া ওই ভিকটিমের সঙ্গে আসামি দেলোয়ারের যৌন সম্পর্ক ছিল বলেও মনে করে কমিটি। এমনকি ভিকটিমের ভাসুরও সন্ত্রাসীদের সহচর বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটির দাখিল করা এ প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপিত হয়। আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ২৯ নভেম্বর দিন রেখেছেন।

আদালতে বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার খন্দকার রেজা-ই-রাকিব। ঘটনাটি আদালতের নজরে আনায়নকারী আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও আব্দুল্লাহ আল মামুন।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী। পরে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতিবেদনে স্বামীর সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে। অবহেলা পাওয়া গেছে প্রশাসনের। চৌকিদার মেম্বার, চেয়ারম্যান, অফিসার ইনচার্জ এবং এএসপি বেগমগঞ্জ। এ অবহেলার কারণে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে কমিটি।

বিটিআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আদালতের আদেশ মতো একটি কপি সংরক্ষণ করা হয়েছে। একটি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ফেসবুক বিটিআরসিকে ফুটেজ সরানোর কথা ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়েছে।

এর আগে গত ৫ অক্টোবর ঘটনাটি আদালতের নজরে আনার পর ফুটেজ সরাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সিডি বা পেনড্রাইভে কপি রেখে ভিডিও ফুটেজ সরাতে বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।

এছাড়া ওই নারীর পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ঘটনার বিষয়ে ভিকটিমের বক্তব্য গ্রহণে পুলিশের কোনো অবহেলা আছে কিনা তা অনুসন্ধান করতে একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন আদালত। কমিটিকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

ওই ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার সবশেষ অবস্থা জানিয়ে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আদালতকে প্রতিবেদন দিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ সব আদেশ অনুসারে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে আদালতকে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।

প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুসারে, ওই এলাকার ৯ নং ওয়ার্ড মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগ, এলাকার চৌকিদার, বেগমগঞ্জ থানার দুই এসআই, বেগমগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ চৌধুরী এবং বেগমগঞ্জ সার্কেলের এএসপি শাহজাহান শেখ ঘটনা সম্পর্কে কমিটির কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অগ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত নয় বলে তাদের বিষয়ে আদালত কর্তৃক যৌক্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া যায় বলে কমিটি উল্লেখ করেন।

ভিকটিমের স্বামী সাইফুল ইসলাম সুমন সম্পর্কে কমিটির ভাষ্য, ঘটনা সম্পর্কে সব অবগত হওয়া সত্ত্বেও বিচার দাবি করে কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। তার অবস্থান সন্দেহজনক। তাই তাকে আইনের আওতায় এনে ঘটনা সম্পর্কে তার সম্পৃক্ততা যাচাই করা যায়।

তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার ৭ নং একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে সংঘঠিত নারী নির্যাতনের ঘটনা অত্যন্ত নৃশংস, অমানবিক ও নারীত্বের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননাকর।

ভিকটিম সম্পর্কে বলা হয়, ১০/১২ বছর ধরে গৃহবধূ হিসেবে তিনি জীবন যাপন করেন। তিনি একাকী বাস করতেন, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন কোনো স্বজন তার সঙ্গে থাকতো না, পিতাও অন্যত্র বসবাস করেন। তার ঘরকে কেন্দ্র করে একটি চক্র গড়ে ওঠে। বিষয়টি রহস্যজনক বলে প্রতীয়মান হয়।

‘ভিকটিম দেলোয়ারের সঙ্গে ২ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পূর্ব হতে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যা এলাকার বখাটে সন্ত্রাসীদের জানা ছিল। ভিকটিম তার ভাষ্যে তা স্বীকার করেন। ভিকটিমের স্বামীর সাথে তার আপস-মীমাংসার খবর যৌন লিপ্সু সন্ত্রাসীদের সুযোগ হাতছাড়ার বেদনায় উদগ্রীব করে। দেলোয়ার ভিকটিমের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশংকা করে বলে প্রতীয়মান হয়। ’

ভিকটিমের ভাসুর মিনা সন্ত্রাসীদের একজন সহচর বলে জানা যায়। ঘটনার দিনে বিষয়টি আকস্মিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ নারকীয় ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে, যাতে ভিকটিমের স্বামী ঘরে ফিরে যেতে না পারে। ভিকটিমকে মারধর করা, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা এবং যৌন নিপীড়ন করা ছিল সন্ত্রাসীদের এক ধরনের বিকৃত উল্লাস ও শক্তি প্রদর্শন বলে কমিটি পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে।

ঘটনার বিশ্লেষণ করে কমিটি জানায়, ঘটনার মাস্টারমাইন্ড দেলোয়ার। তিনি আড়ালে থেকে তার অনুগত বাদল, কালাম গংকে ব্যবহার করেন। দেলোয়ারের পক্ষে ও নিজেদের কুপ্রবৃত্তি ও লালসা চরিতার্থ করার জন্য এজাহারভুক্ত সন্ত্রাসীরা এ নারকীয় ঘটনা ঘটান।

ঘটনাটি ন্যক্কারজনক নৃশংস ও অমানবিক, যা বাংলাদেশের জনগণের মানবিক চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া উচিত, যাতে দেশে এ ধরনের ঘটনা সংঘটনে কেউ কখনো সাহস না করে।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ অংশে বলা হয়-
নারীর সম্ভ্রমহানির বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যসূচিতে ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে।

সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী প্রমাণ যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয় না। ফলে অনেক গুরুতর অপরাধীর আটক হয়েও জামিনে মুক্ত হয়ে ক্রমিক সন্ত্রাসে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যেমন বেগমগঞ্জের কথিত সুমন ও সম্রাট বাহিনী।

এলাকা ভিত্তিক সন্ত্রাসী ব্যক্তির নামে গঠিত বাহিনীকে বিশেষ অর্ডিন্যান্স/আইন পাসের মাধ্যমে নির্মূলের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিশেষ আদালতে অতি অল্প সময়ে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ব্যক্তি নামে সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন, পরিচালনা ও অপরাধ সংগঠন রাষ্ট্র ও নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা। সাড়াশি অভিযান চালিয়ে এদের নির্মূল করা এখন সময়ের দাবি। গ্রাম পুলিশ ও বিট পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদার এবং জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের নজরদারি আরো জেরদার করতে হবে।

কমিটির প্রধান ছিলেন চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবুল বাশার। সদস্য ছিলেন নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসরাত সাদমীন এবং জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২০
ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।