এক. “ভাই, আপনারা কি আম্লীক করেন”?
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট-এর পরের কোনো একদিনের ঘটনা। রিকশায় আমি আর এক বড় ভাই ফিরছিলাম।
আমার শিক্ষক জহির স্যার এর একটা কথা মনে পড়লো : "গান কখনো রক্ত ঝরায়না ,ঝরা রক্তে জীবনের গান শোনা যায়"।
আর আজ বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে গিয়ে দেখলাম, একজায়গায় আব্বাসউদ্দিন-এর গান শোনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখছেন: "পথে পথে গান চললো। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন আহমেদের গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেতো।
তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তার গান শুনছে..'বাংলাকে ভালো না বাসলে এই গানের মাধূর্য ও মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে'। "
গানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দর্শন ওই রিকশাওয়ালা জানলো কেমন করে? কি এর ব্যাখ্যা?
ওই রিকশাওয়ালাকেও শিক্ষকের আসন দিয়েছিলাম। আজও সেই সম্মান দিয়ে চলেছি মনে মনে।
দুই. আদা চাচার রক্ত
আদা চাচা ১৯৬০ সাল থেকে আওয়ামী লীগের এমন কোনো কর্মসূচী নেই যাতে অংশ নেননি। খয়েরি পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরা আদা চাচা। যিনি আদা খাইয়ে সবার কন্ঠ সচল রাখতেন রাজপথের মিছিলে। ২১ আগস্ট ২০০৪ ঘাতকের নিষ্ঠুর গ্রেনেড অন্য ২২ জনের সাথে আদা চাচার প্রাণচাঞ্চল্য স্তব্ধ করে দিয়েছে। তার রক্তের উপর পাড়া দিয়ে গজে উঠেছে নব্য পুঁজিবাদী 'রাঙ্গা' আওয়ামী লীগাররা। এ রাঙ্গা মানে সুবিধাবাদী। শুনুন প্রকৃত 'রাঙা'র কথা।
তিন. রাঙা চাচার 'হাচেনা ও শ্যাখ সাহেব':
আমার এক চাচা ছিলেন। গাঁয়ের রঙ কালো হলেও আমরা সবাই তাকে 'রাঙা চাচা' বলতাম। তার মুখে 'গুলে বাকাওয়ালী'র কেচ্ছা শুনে আমাদের বড় হয়ে ওঠা।
১৯৯৬ সালের দিকের কথা। থিন থিনে পাতলা গড়নের লম্বা এই মানুষটি শেখ হাসিনাকে শুধু 'হাচেনা' বলতেন। বলার সময় আমরা তার মধ্যেমুখে অদ্ভুত একধরনের আল্ল্বাদ দেখতে পেতাম। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে' হাসিনা বানানটি 'হাচু' এবং 'হাচিনা' লেখেন !
পিতৃ-সুলভ ভালোবাসার একি সার্বজনীনতা! রাঙা চাচা একবার এক নির্বাচনে নিজের ঝাঁড়ের বাঁশ কেঁটে, নিজের টাকায় কাগজকিনে বিশাল নৌকা বানিয়ে এক নির্বাচনী মিছিলে যান।
প্রার্থী তার মেধাকে মূল্যায়ন করেননি, বা খেয়াল করেননি। চায়ের দোকানে এ নিয়ে লোকজন তাকে টিটকারী মারতে থাকলো। চাচার আদা চা হয়তো একটু বেশিই তেতো লেগেছিলো সেদিন । পরের দিন সকালে রাঙা চাচার সাথে আমার কথা হয়েছিলো ।
চাচা বলতে থাকেন: "বাজান, স্বপ্নে দেহি এক আলখেল্লা পরা লোক আমাগের উঠানে আয়ছে। ভালোভাবে খিয়াল করে দেহিশ্যাখ সাহেব!" ....."শ্যাখ সাহেব আমারে বার্তা নিলেন 'তুমরা আমারে মেরে কি সুখে আচ"!!! চাচা বললেন: "তারে দরবেশের মতোলাগছিল"......"তারপর আমার ঘুম ভাইঙ্গে গিলো"।
আমি রাঙা চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে তার বেদনা বুঝার চেষ্টা করি। বুঝি কিম্বা বুঝিনা।
আহমদ ছফা তার 'একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন' উপন্যাসে শেখ মুজিবকে হয়ত ব্যঙ্গ করেই কিনা জানিনা বলেছেন 'জয় বাংলার দরবেশ'। কিন্তু রাঙা চাচার এই নিরুপনে কোনো খাঁদ নেই। রাজনীতির কবি শেখ মুজিব 'দারে দারে' সাধক 'বেশে' ঘুরে বেড়ান তার প্রিয় 'বাংলার দুঃখী'মানুষের খোঁজ জানতে। তাই তিনি রাঙা চাচার ভাষায় 'দার ভিস' !
রাঙা চাচা লেখা পড়া জানতেন না। ২০০০ সালে তিনি কুকুরের কামড়ের পরে বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
চার. 'শাজাহান-রে আম্লীগ ক্ষমতায় আয়ছে'
এই গল্পটা এক বড় ভাইয়ের কাছে শোনা। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগের কথা। গ্রামের তৃণমূল আওয়ামী লীগ কর্মী শাজাহান অসুস্থ। নির্বাচন পর্যন্ত বাঁচবেন কিনা ভরসা নেই। তাই এক বড় নেতা তাকে দেখতে আসলে তিনি আর্তি করে বলে উঠেন: আমি মারা গেলে, ভাই, আমার কবরে এসে বইলেন 'শাজাহান-রে আম্লীগ ক্ষমতায় আয়ছে। "....শাজাহান ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা দেখে যেতে পারেননি। কী ভীষণ আবেগ!
এমনি করে সিলেটের সুরমা নদীতে নৌকা চালানো মুক্তিযোদ্ধা হাবিব মাঝি পকেটে পত্রিকায় ছাপা হওয়া বঙ্গবন্ধুর ছবির কাটিংস যত্ন করে মুড়িয়েরাখেন আর মাঝে মাঝে বের করে দেখেন। পত্রিকায় পড়েছিলাম খবরটি, তাও বেশ কিছু বছর হলো। আর যে মাটিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত ঝরেছে সেই মাটিতে আর জুতা/স্যান্ডেল না পরার গল্প হাজার মানুষের।
খাবার সময় বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শুনে হাত থেকে মাছের টুকরা পড়ে গিয়েছিলো কার যেন। হত্যাকারীদের ফাঁসি না হওয়া অবধি সেই লোক আর মাছ-মাংশ খাননি। কি অহিংস প্রতিশোধ স্পৃহা!
এই ত্যাগ, এই ভালবাসা, এই স্নেহ, এই আবেগ, এই দর্শন, এই উৎর্গ আজকের আওয়ামী লীগ কি খরচ করে ফেলল? আহমদ ছফা নাকি বলেছিলেন: যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জেতে, তবে শুধু আওয়ামী লীগের নেতারা যেতে, আর যদি আওয়ামী লীগ হারে তবে সারা দেশের মানুষ হেরে যায়। কথাটা আমরা বিশ্বাস করতে চাইনা।
এস. এম. মাসুম বিল্লাহ, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটনে উচ্চশিক্ষারত। ই-মেইল: billah002@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৪