ঢাকা: জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় দায়ের করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আরও দুই মাস সময় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ওই আদেশ দেন।
পাশাপাশি শেখ হাসিনার বিষয়ে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে অগ্রগতি জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিকে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রীসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধেও দুই মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এজলাস থেকে বেরিয়ে ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আজকে দুটি মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল। একটি হচ্ছে বাংলাদেশে গত ১৬ বছর ধরে যে মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, সে অপরাধের প্রধান আসামি ও নিউক্লিয়াস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় মামলাটি হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদের যে সমস্ত সিনিয়র সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ক্যাবিনেটের উল্লেখযোগ্য সদস্যসহ যারা শেখ হাসিনাকে এ ধরনের অপরাধের জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও এটাকে উসকানি দেওয়াসহ নানাভাবে অপরাধ সংঘটনের ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মামলার নির্ধারিত তারিখ ছিল।
‘আমরা আজকে অপরাধের যে নিউক্লিয়াস শেখ হাসিনার মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতের কাছে উপস্থাপন করেছি। তার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। পাশাপাশি জুলাই আগস্টের গণহত্যার বাইরেও গত ১৬ বছর ধরে সিস্টেমেটিক্যালি দেশের হাজার হাজার মানুষকে শেখ হাসিনার নির্দেশে ও তার পরিকল্পনায়, গোপন কারাগারে নিষ্ঠুরতম পন্থায় বছরের পর বছর আটক রেখে নির্যাতন, হত্যা করা ও তাদের লাশকে সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে বেঁধে বিভিন্ন নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সে বিষয়ে বর্তমান সরকারের গঠিত গুম কমিশনের কাছে যে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন আছে, তার কিছু অংশ যা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব অপরাধের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পৃক্ত ছিলেন বলে গুম কমিশন খুঁজে পেয়েছে। মানুষকে গুম করার পর কোথায় রাখা হয়, গুম কমিশন সেসব স্থান ভিকটিমদের মাধ্যমে স্বশরীরে সনাক্ত করেছে। ’
তাজুল ইসলাম বলেন, গুম কমিশনের এই তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা যেসব অপরাধ পেয়েছি তা ট্রাইব্যুনাল আমলে নিয়েছেন। একই সঙ্গে আমরাও এ বিষয়ে রিপোর্ট দেব। এক সঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও গুম সংক্রান্ত যে অপরাধ সেগুলোকে মিলিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত। আমরা দুই মাস সময় চেয়েছি। আদালত আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন৷
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করব এ সময়ের মধ্যে পুরো তদন্ত প্রতিবেদন বা এর অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে। এ বিষয়ে আমরা দিন রাত চেষ্টা করব।
তাজুল ইসলাম বলেন, গুম কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে বা যেসব প্রকাশিত হয়নি সেগুলো আইন অনুযায়ী চাওয়ার অধিকার আমাদের আছে। এসব যেহেতু অফিশিয়াল ডকুমেন্ট তাই আদালতে দেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, এর আগে ড. আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত না থাকায় আজকে তার বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তারসহ বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান।
তাজুল ইসলাম বলেন, ওবায়দুল কাদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর বাংলাদেশে তিন মাস ছিলেন। এরপরও তিনি কোথায়-কীভাবে ছিলেন এবং কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বা তিনি কীভাবে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করেছেন এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে একটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই ব্যাখ্যা যেন দেওয়া হয় সে ব্যাপারে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, এর সঙ্গে অপরাধের নিউক্লিয়াস শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আদালত জানতে চেয়েছেন। এছাড়া ভারতের সঙ্গে যেসব দেশবিরোধী চুক্তি করা হয়েছে সেসবের ব্যাপারে কতদূর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি জানার জন্য আদালত পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে একটা প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন। মোটা দাগে আজ এটুকুই ছিল আজকের কোর্টের (আদালতের) কার্যক্রম।
তিনি আরো বলেন, এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া পৃথিবীর অন্য মামলার চেয়ে ব্যতিক্রম। তদন্ত শেষ হতে কতদিন সময় লাগবে সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। এটার গভীরতা ও মাত্রা অনেক বেশি। কত দিনের মধ্যে এর তদন্ত শেষ হবে সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো অবস্থা এখনো আসেনি। আমরা চেষ্টা করব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারগুলোকে শেষ করার অথবা বিচার প্রক্রিয়ার জন্য মামলা প্রস্তুত করার। তবে আমরা যত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে সেগুলো ব্যবহার করছি। মামলাগুলো কেমন করে বিচারের জন্য প্রস্তুত করা যায় সে ব্যাপারে চেষ্টা করছি।
তাজুল ইসলাম বলেন, ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও তিনি দেশে ছিলেন। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সেজন্যই আদালত আজকে ব্যাখ্যা চেয়েছেন, উনি কোথায় কীভাবে ছিলেন, কীভাবে পালালেন এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একটি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি জাতীয় ট্রাইব্যুনাল। এটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। এই ট্রাইব্যুনালের আদেশ-নির্দেশ যদি কোনো সংস্থা বা বাহিনী না মানেন তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা রাষ্ট্রের কাজে সহযোগিতা করছেন না এবং আইন অনুযায়ী কাজ করছেন না।
তাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম অবস্থায় তাদের শুধু এটুকু বলব, ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মানতে হবে। এটা আপনার আইনগত দায়িত্ব ও রাষ্ট্রের প্রতি আপনার আনুগত্যের প্রশ্ন। যদি কেউ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরও কোনো আসামিকে পালাতে সহযোগিতা করে তাহলে ধরে নিতে হবে তারা আইন অনুযায়ী কাজ করছেন না। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আমরা এখনই সেদিকে যাব না। সবার প্রতি আহ্বান জানাবো, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য নয় বরং আপনারা আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আপনাদের আনুগত্য দেখাবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪
ইএসএস/এইচএ/