ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

মানুষের চিরশত্রু শয়তান সম্পর্কে সাবধান করা রয়েছে সূরা আরাফে

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৫
মানুষের চিরশত্রু শয়তান সম্পর্কে সাবধান করা রয়েছে সূরা আরাফে

সূরা আল আরাফ একটি মক্কি সূরা। এটি পবিত্র কোরআনের ৭ নম্বর সূরা।

এই সূরার মোট আয়াত সংখ্যা ২০৬টি। এতে রয়েছে ২৪টি রুকু। আরাফ আরবি শব্দ। অর্থ উঁচু স্থান। আরাফ বলা হয়, জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে অবস্থিত একটি বিশেষ স্থানকে।

এ সূরায় আরাফ সম্পর্কিত বেশকিছু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে বলেই এই নামকরণ করা হয়েছে- আরাফ।

ধর্মীয় নানা বিশ্বাসগত বিষয় ছাড়াও এই সূরার কয়েকটি মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে- প্রথম মানব হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টির ব্যাখ্যা, মানুষের প্রতি হুঁশিয়ারি,  মানুষকে সুপথ দেখানোর ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে নেয়া মহান আল্লাহতায়ালার অঙ্গীকার, তাওহিদ বা একত্ববাদ ও সুপথ থেকে বিচ্যুত নানা জাতির পরিণতি, প্রকৃত মুমিনদের বিজয়, অতীতের কয়েকটি জাতির ও কয়েকজন নবীর (আ.) ঘটনা।

সূরা আরাফে সাংস্কৃতিক, চারিত্রিক ও নৈতিক নানা বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয়েছে। যেমন, কোরআনে কারিম ঐশী বা খোদায়ি গ্রন্থ, এর অনুসরণ করার অপরিহার্যতা, মিজান কী, হজরত আদম (আ.)-এর ঘটনা ও এর নৈতিক পরিণতি, মানবজাতির জন্য উপদেশ এবং কিয়ামত সংঘটনে ক্ষণকালও দেরি না হওয়া বা নির্ধারিত সময়ের এক মুহূর্ত আগেও তা না ঘটা- ইত্যাদি।

সূরা আরাফের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় হিসেবে অপচয়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা, আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস স্থাপনকারী কাফেরদের অন্তিম অবস্থা, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব সাধ্যের বেশি না হওয়া, জান্নাতবাসীদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, আরাফের বর্ণনা, জাহান্নামীদের কামনা ও প্রার্থনার আদেশও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এ ছাড়া এ সূরায় হজরত নুহ (আ.)-এর ঘটনা ও তার শিক্ষণীয় দিক, হজরত হুদ (আ.)-এর ঘটনা ও তার ফলাফল, হজরত সালেহ (আ.)-এর ঘটনা ও তার উদ্দেশ্য, হজরত লুত (আ.)-এর ঘটনা, পুরুষ সমকামিতার নিন্দা, হজরত শোয়াইব (আ.)-এর ঘটনা, পরিমাপে কম দেওয়ার নিন্দা, দস্যুবৃত্তির অবৈধতা, হজরত মুসা (আ.)-এর ঘটনা ও তার চারিত্রিক ফল, হজরত হারুন (আ.)-এর খিলাফত, চাক্ষুষভাবে আল্লাহতায়ালাকে দেখা অসম্ভব হওয়া, আল্লাহতায়ালার কথপোকথন এবং সামেরির গো-বৎস তৈরির ঘটনাও এই সূরার অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু।

সূরা আরাফে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা, বিচ্যুত বনি ইসরাইলি আলেম বালাম বাউরার ঘটনা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কিয়ামত সংঘটনের বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার ঘোষণা, মানব সমাজের প্রকৃতি, আরবের মুশরিকদের অবস্থা ও জামাতে নামাজ আদায়ের নির্দেশও এই সূরার অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরি কিছু আলোচ্য বিষয়।

যেমন, সূরা আরাফের দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘এটি একটি গ্রন্থ, যা আপনার ওপর নাজিল হয়েছে, যাতে করে আপনি এর মাধ্যমে ভয় দেখান। তাই এটি পৌঁছে দিতে আপনার মনে কোনোরূপ দুঃখ থাকা উচিত নয়। আর এটিই বিশ্বাসীদের জন্যে উপদেশ বা সতর্কবাণী। ’

এই আয়াতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সান্ত্বনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলছেন, কোরআনের আয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে বলে তা প্রচারের ব্যাপারে আপনার মনে কোনো ভয় বা আশঙ্কা থাকা উচিত নয়। রেসালাতের কঠিন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারেও আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না।

কোরআনের বাস্তবতা বা সত্যগুলোর ব্যাপারে শত্রুদের দুর্বিনীত আচরণ ও কঠোর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও আপনার কোনো ভয় থাকা উচিত নয়।

সূরা আরাফের ১১ থেকে ২৭ নম্বর আয়াতে হজরত আদম (আ.) সৃষ্টির ঘটনা এবং প্রতিনিধিত্বের সম্মান দেওয়ার কারণে তাকে সিজদা করতে ফেরেশতাদের প্রতি নির্দেশ দান ও  এ ব্যাপারে শয়তানের বিদ্রোহের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এর পর ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ বললেন, আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সিজদা করতে বারণ করল? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে। ’ আল্লাহ বললেন, তুই এখান থেকে যা। এখানে অহংকার করার কোনো অধিকার তোর নাই। অতএব তুই বের হয়ে যা। তুই হীনতমদের অন্তর্ভুক্ত। ’

আসলে শয়তান একটি উপাদানকে অন্য উপাদানের সঙ্গে তুলনা করে ভুল করেছিল। তার ভুলের কারণ হলো এটা যে, সে বস্তুগত দিককে লক্ষ্য করলেও অন্য দিকগুলোকে সামান্যতমও গ্রাহ্য করেনি। অথচ সবকিছুর আগে তার উচিত ছিল মহান আল্লাহর হেকমত বা প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা এবং মানুষের সৃষ্টির অবস্তুগত ও ঐশী দিকটিকে গ্রাহ্য করা। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি নিজ রুহ হতে তার সত্তায় ফুঁকে দিয়েছি। ’ অর্থাৎ মানুষকে ঐশী গুণাবলী অর্জনের উপযোগিতা দান করেছি যার ফলে সে ঐশী বা খোদায়ী নামগুলোর রহস্য সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এটাও দেখা উচিত ছিল যে, স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করবো। ’ তাই আল্লাহ যাকে ঐশী গুণাবলী অর্জনের বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং নিজ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ অন্য কে হতে পারে? আসলে শয়তান যদি এ বিষয়গুলো সামনে রেখে চিন্তা করতো তবে সে এমন বড় ভুল করতো না এবং উচ্চ অবস্থান হারিয়ে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হত না।

শয়তান তার ভুলের জন্য ক্ষমাও চায়নি, বরং ভুল বা অন্যায় জিদের ওপর অটল রয়েছে এবং মানুষের বিরুদ্ধে তার হিংসার  আগুন চির-জাগ্রত করে রেখেছে। সে আল্লাহর কাছে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ চেয়েছে এবং আল্লাহও তাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার শপথ নিয়েছে সে। মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়ার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে তাকে। অবশ্য আল্লাহ শয়তানের হাত থেকে রক্ষার ও সৌভাগ্য লাভের সরঞ্জাম হিসেবে মানুষকে দিয়েছেন পবিত্র প্রকৃতি, বিবেক-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য পাঠিয়েছেন নবী-রাসূল।   

শয়তান বস্তুগত বিষয়েও ভুল করেছে। কারণ, কয়েকটি দিক থেকে মাটি আগুনের চেয়ে শ্রেয়। কোনো জিনিস আগুনে পড়লে তা ছাই হয়ে যায়। তাই আগুন হচ্ছে অবিশ্বস্ত, আত্মসাৎকারী ও বিদ্রোহী। অথচ মাটি তেমন নয়, বরং বিনম্র। মাটি চিত্রিত হয়, কিন্তু আগুন বিকৃত করে দেয়, মাটি উদ্ভাবক আর আগুন বিধ্বংসী। তাই এটা স্পষ্ট যে, শয়তান সব দিক থেকেই ভুল করেছে। শয়তানই সর্বপ্রথম দুনিয়ায় খোদাদ্রোহিতা, ঝগড়া-বিবাদ ও কিয়াসের তথা সদৃশ অনুমানের ভিত্তিতে তুলনা করার প্রথা চালু করেছে। সেই শয়তান মানুষের চিরশত্রু। এটা মনে করে জীবন পরিচালনার শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে।

এ সূরায় নবীর প্রতি ঈমান আনার পর তার সঙ্গে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করার ক্ষতি, নবীর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করার পরিণাম, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও মিথ্যার প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান ও সমর্থন প্রদানের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। এক কথায় মানবজীবনের ঘণিষ্ঠ বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোচান ও বিধান স্থান পেয়েছে এ সূরায়।



বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।