ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভারত

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিকদের মাতামাতির নেপথ্যে কী?

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিকদের মাতামাতির নেপথ্যে কী? বাংলাদেশবিরোধী উন্মাদনায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় আছেন মমতা বন্দোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী

কলকাতা: ‘দুই বাংলার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দু-একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনার কারণে তা নষ্ট হবে না।

ভারতে যা হচ্ছে তা রাজনৈতিক ফায়দা তোলা বা উস্কানিমূলক আচরণ। এর বাইরে আর কিছু না। ’

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ইস্যু ধরে ভারতীয় রাজনীতিকরা যে উন্মাদনায় মেতেছেন, তা নিয়ে এমনই অভিমত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বিশ্লেষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের।

তারা বলছেন, উন্মাদনা তৈরি করে ত্রিপুরায় যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, সে পথে হাটবে না পশ্চিমবঙ্গ। বাংলাদেশিদের জন্য আগের মতোই আন্তরিক থাকবে কলকাতার জনসাধারণ।

সচেতন মহল বলছে, ভারতের ২৮টি রাজ্য-অঞ্চলের মধ্যে বেশিরভাগ জায়গায়ই বিজেপির সরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তারা এখনো সুবিধা করে উঠতে পারছে না। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের দলটি বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যটিও নিয়ন্ত্রণে নিতে বহু বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামী ২০২৬ সালে এখানে বিধানসভা নির্বাচন হবে। তার আগে বাংলাদেশ ইস্যুতে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে রাজ্যের সনাতনী ভোটারদের তারা এ বার্তা দিতে চাইছে যে, সম্প্রদায়টির জন্য তারা কতটা আন্তরিক।  

বিজেপির রাজ্য শাখার নেতা ও বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী নানা সভা-সমাবেশে বাংলাদেশকে নিয়ে কটাক্ষ করে হুমকি-ধমকি দিয়ে এই উন্মাদনা তৈরিতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছেন। আর বিজেপির ভোট বাগানোর এই চেষ্টা দেখে পিছিয়ে থাকতে চাইছেন না রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা ব্যানার্জীও। তিনি বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব পর্যন্ত করে ফেলেন, যা তাকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলেছে।

এ বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. কনক সরকার বাংলানিউজকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা বাংলাদেশিদের জন্য সবসময় সেফ। বিজেপির মতো যেসব রাজনৈতিক দল ময়দানে নেমে বাংলাদেশ ইস্যুতে মাঠ গরম করছে, তারা নিজেদের ফায়দা ছাড়া আর কিছুই করছে না। তাদের যদি এতটাই দরদ থাকতো, তাহলে মিটিং-মিছিল না করে সরাসরি তাদের দাবি-দাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারকে বলতে পারতো। কিন্তু তা না করে উত্তেজনা তৈরি করছে। আসলে ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট, এই বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে নিজেদের জমি শক্ত করতে চাইছে।  

এই বিশ্লেষক বলেন, ভোটকে সামনে রেখে তারা দেখাতে চাইছে হিন্দুদের জন্য তারা কতটা আন্তরিক। তাই যদি হতো, তাহলে ৫ আগস্টের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে চেয়েছিল বলে খবরে দেখা গেছে। আমার দেখেছি, চ্যাংড়াবান্দা ও হিলির সামনে অনেকে এসেছে। তাদের যদি এতো হিন্দু প্রীতি থাকত তাহলে কেন ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো না। তারা তো সেই সময় ভারত সরকারকে এ নিয়ে বলতে পারতো। কিন্তু কারও মুখে এই নিয়ে একটা কথা শুনেছেন? উল্টো দেখলাম, সেখানে হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি আগলে রাখছেন সেদেশের মুসলমানরা। অর্থাৎ এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে এরা পশ্চিমবঙ্গের মাঠ গরম করতে চাইছে। লক্ষ্য করে দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা ছাড়া এই ধরনের সমস্যা ভারতে সেভাবে দেখার নেই। অর্থাৎ এটা ভোটের রাজনীতি।  

বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য মমতা ব্যানার্জীর প্রস্তাবের বিষয় সিপিআইএমের নেতা সুজন বলেন, আমরা বারবার বলি তৃণমূল কংগ্রেস হলো বিজেপির বি-টিম। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মমতার ওই বক্তব্য না রাখলে দেখা যেত তার রাজ্যের দুর্নীতি তার ভাতিজাকে (অভিষেক ব্যানার্জী) কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তুলে নিয়ে গেছে। একটা চিত্র স্পষ্ট দেখে বুঝুন না, যেখানে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অর্থাৎ আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তিহার জেলে যেতে হলো। ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক দল ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার প্রধান শিবু সোরেনকে সামান্য জমি মামলা দিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তিহার জেলে পাঠালো। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি। একবারও দেখেছেন, এখানকার শাসকদলের কোনো বড় মাথাকে গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা? যাদের গ্রেপ্তার করেছিল তাদের অনেককে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিচ্ছে।  

‘আমরা বরাবরই বলে এসেছি, তৃণমূল কংগ্রেস হল বিজেপির হয়ে কাজ করে। ফলে মমতাকে মাঝেমধ্যে এই ধরনের বক্তব্য দিতেই হবে’, যোগ করেন সুজন।

হতাশ ব্যবসায়ীরা
এদিকে দুই দেশের মধ্যে ছড়ানো উত্তপ্ততার জেরে কলকাতায় ‘মিনি বাংলাদেশ’ বলে পরিচিত মারক্যুইস স্ট্রিটের অবস্থা শোচনীয় হয়েছে। জরুরি মেডিকেল ভিসা ছাড়া আপাতত বাংলাদেশিদের কোনো ভিসা দিচ্ছে না ভারত। ফলে বাংলাদেশি না থাকায় মারক্যুইস স্ট্রিটের ব্যবসায়ীদের অলস সময় যাচ্ছে। পড়েছেন অর্থনৈতিক জটিলতায়।

এই অঞ্চলের কাশ্মীরি শাল ব্যবসায়ী অর্থাৎ কাশ্মীরি আর্ট বাজারে মালিক মো. বসির বলছেন, পুরনো ভিসায় বাংলাদেশিরা টুকটাক আসছেন। নতুন ভিসা বন্ধ। কেন বন্ধ করা হয়েছে আমাদের স্পষ্ট করেও কিছু বলা হচ্ছে না। কলকাতার মারক্যুইস স্ট্রিট অঞ্চল পুরোটাই বাংলাদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। এখন একেবারেই ফাঁকা। কোনো বেচকেনা নেই। সারাদিনেও দোকানের খরচা উঠছে না। কাশ্মীরে জমি-বাড়ি বেচে গত ২০ বছর ধরে কলকাতায় আছি। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে আবার ফিরে যেতে হবে।  আমরা চাই পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হোক এবং দুই দেশের মানুষ আবার আগের মত যাতায়াত করুক।  

নিশ্চিন্তে বাংলাদেশিদের আসার আহ্বান আরএন টেগোর হাসপাতালের
কলকাতার হাসপাতালগুলো বলছে, সম্পর্ক তৈরি করতে সময় লাগে, আর ভেঙে দিতে এক মুহূর্ত সময় লাগে না। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও বেশি পুরনো। দু-একটা কারণে ভেঙে যাবে না।  

কলকাতার আরএএন টেগোর হাসপাতালের আন্তর্জাতিক রোগী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত জয়ন্ত চৌধুরী বলছেন, বহু বাংলাদেশি বর্তমানে আমাদের হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের পরিবার কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের হোটেলে আছে। কোথাও কি শুনেছেন, বাংলাদেশি বলে হোটেল দেওয়া হবে না বা তাদের নিয়ে কলকাতায় কোনো গন্ডগোল? আমি আপনাদের মাধ্যমে বলবো, আমাদের কাছে বহু বাংলাদেশি চিকিৎসার পাশাপাশি খোঁজ নিচ্ছে যে এখন কলকাতা যাওয়া সেফ হবে তো! আমি বলবো নিশ্চিন্তে আসুন। এখানে কোনো ভয় নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২৪
ভিএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।