ঢাকা: বায়ুদূষণের পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণজনীত নানান স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং রোগব্যাধি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশগত কারণে প্রতি বছর ১ কোটি ৩ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে।
বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। বিশ্বের ১২৫টি নগরীর মধ্যে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) সকালে বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা।
শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকেও ঢাকা বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে আইকিউ এয়ারের মানসূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৫৩। বায়ুর এই মানকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে ২.৫ এর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে ৩২ গুণ বেশি।
ঢাকার বায়ুতে ক্ষতিকর উপাদান প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, দূষিত বায়ুতে যা থাকে তার সব কিছুই মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ এবং গ্যাস থাকে। এর মধ্যে আছে হাজার রকমের অর্গানিক কার্বন, ব্ল্যাক কার্বন, হেভি মেটাল, সালফেট, ফসফেট, নাইট্রেট, লেড, ক্যাডিয়াম, মার্কারি। আবার গ্যাসের মধ্যে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, এমোনিয়া, মিথেন, কার্বন মনো অক্সাইডসহ আরও অনেক ধাতু থাকে। যার প্রত্যেকটিই মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
পরিবেশবিদ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস বেড়ে যাওয়ায় বায়ু দূষণ বাড়ছে। বায়ু দূষণের ফলে বাতাসে প্লাস্টিক কণা, সীসার মত ক্ষতিকর উপাদানও বাড়ছে। এ সমস্ত উপাদান মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি।
চিকিৎসকেরা বলছেন, বায়ু দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্য। দূষিত বায়ুর বিষাক্ত উপাদান মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এতে পুরুষের শুক্রাণু তৈরির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্তের ক্ষমতা রাখে, এমন সুস্থ সবল শুক্রাণু কম তৈরি হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটছে। ডিম্বাণু তৈরির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আবার দুর্বল অসুস্থ ডিম্বাণু তৈরি হচ্ছে। এসব ডিম্বাণু যখন শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হয়ে ভ্রূণ তৈরি করছে, সেই ভ্রূণ জরায়ুর নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান তৈরি করতে পারে না। ফলে গর্ভপাত হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু প্রেগন্যান্সিতে গর্ভাবস্থায় শিশু বাড়ছে না। এ ধরনের শিশু গর্ভেই মারা যাচ্ছে, না হয় অতিরিক্ত অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এ ধরনের দুর্বল শিশু জন্মের পরও বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। এসবের মূল কারণ বায়ুদূষণ।
প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, যখন কোনো টক্সিক পার্টিক্যাল শরীরের মধ্যে রক্তে কিংবা টিস্যুতে জমা হতে থাকে তখন এন্ড্রোকাইন ডিসরাফটোরস (Endocrine disruptors) হয়। শরীরে এন্ড্রোকাইন ডিসরাফটোরস হলে শরীরে হরমোনের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। যেমন ইনসুলিন, টেস্টোস্টেরন এগুলো একেকটা হরমোন। টেস্টোস্টেরনের বিঘ্ন ঘটলে শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যায় কিংবা স্পামের পরিমাণ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে।
তিনি আরও বলেন, বায়ু দূষণের ক্ষতিকর পার্টিকেল যেমন মাইক্রো প্লাস্টিক, সীসা, মার্কারির মত ক্ষতিকর পদার্থগুলো আমাদের শরীরের এন্ড্রোকাইন সিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করে হরমোনাল ব্যালেন্সকে প্রভাবিত করে। দূষিত বায়ুর মধ্যে অনেক ক্ষতিকর কেমিক্যাল থাকে সেগুলো আমাদের শরীরের বায়োকেমিক্যাল ব্যালেন্স নষ্ট করে দেয়। এতে হরমোনাল গ্লান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রভাব পরে আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের উপরে। অর্থাৎ বায়ু দূষণের ক্ষতিকর পদার্থগুলো আমাদের রিপ্রোডাক্টিভ হেলথসহ শরীরের অন্যান্য সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে। বায়ু দূষণের ফলে শরীরের বহুমাত্রিক ক্ষতি সাধিত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
আরকেআর/এমএম