ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

ফুটবল

মেসি, আরেকবার কি বিশ্বাসী হবেন?

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২২
মেসি, আরেকবার কি বিশ্বাসী হবেন?

কণ্ঠটাই শোনা যায় কেবল। চেহারা দেখা যায় না ঠিকঠাক।

তবুও ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে বেশ। কেন? ‘জানি না ফাইনালে কী হবে তবে এটুকু বলতে পারি আপনি সবাইকে আনন্দিত করতে পেরেছেন...প্রভাবও রেখেছেন জীবনে’ বা এমন কিছু লাইনের জন্য। এতক্ষণে টের পাওয়ার কথা নিশ্চয়ই- বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের পর লিওনেল মেসিকে কথাগুলো বলেছিলেন এক আর্জেন্টাইন সাংবাদিক।  

দায়িত্ব ভুলে তিনি ক্ষণিকের জন্য হয়ে গিয়েছিলেন অনেকের প্রতিনিধি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে তার সেসব কথা। ব্রায়ান লারা তার ক্যারিয়ার সায়াহ্নে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমি কি আপনাদের বিনোদন দিতে পেরেছি?’ লিওনেল মেসি লারা নন। নির্লিপ্ত, বিনয়ী, আলাভোলা। ‘ফুটবল না খেললে হয়তো হালচাষ করতেন...’ আড্ডার আনন্দে ডুবে তাকে নিয়ে বলা হয় এমন। তিনি তাই প্রশ্ন করবেন, ভাবা যায় না তেমন কিছু।

তবুও তাকে উত্তর জানিয়ে দেন কেউ, ‘পেরেছেন’ বলেন জানতে না চাইলেও। কোটি ভক্ত সেসব কথা শুনে বিস্ময়ে ডুবে থাকেন, ‘আরে, আমার মন কীভাবে পড়ে ফেললো...!’ ভদ্রমহিলা মহিলা বলেন, ‘আপনি কোটি আলবিসেলেস্তের হৃদয় ছুঁয়েছেন। ফেক হোক অথবা কল্পনায়; আপনার জার্সি আছে বেশির ভাগেরই...’

তিনি মিথ্যা বলেননি অবশ্যই। ইন্টারনেটের কল্যাণেই ক’দিন পরপর ভেসে উঠে সেসব। ছেঁড়া জামায়, ফুটপাতে দাঁড়ানো কোনো এক কিশোরের পেছনে ইটের কণায় লেখা হয় ‘মেছি’। বানান একদমই মূখ্য হয় না এখানে, বড় হয় বরং ভালোবাসা। দারিদ্রতাতে একটু সুখের খোঁজ এনে দেন ফুটবলের ‘দুঃখী রাজা’।

এসব তো দূর দেশের গল্প। হুলিয়ান আলভারেসের কথাই একবার ভাবুন। বছর এগারো আগের একটি ছবি এখন ভাইরাল বেশ। লিওনেল মেসির সঙ্গে কোথাও একটা দেখা হয়েছিল তার; কোনোরকমে একটি ছবিও তুলে রেখেছিলেন। পরে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নের কথা।  

কী? ‘দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারা...’। ফুটবলের আইডল? ‘লিওনেল মেসি...’। আপনি নিশ্চয়ই খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো মেলাতে শুরু করেছেন এতক্ষণে। অথবা আপনার কল্পনায় ভেসে উঠে এসেছে মেসির অমানবিক অ্যাসিস্টকে গোল বানিয়ে ফেলার পর তার সঙ্গে আলভারেসের ছবিটা।

বিশ্বকাপের সেরাদের একজন, বহু বড় ক্লাবের কাঙ্ক্ষিত ডিফেন্ডারকে স্রেফ বোকা বানিয়েছিলেন। পরে কেউ একজন লিখেছিলেন, ‘মেসি পাঁচজনকে ড্রিবল করে কাটিয়ে যাননি। তবে একজনকে পাঁচবার পরাস্ত করেছেন...’ ড্রিবলিংয়ের সেই সেকেন্ড বিশেকের অনেক অনেকগুলো, আলভারেসের শট, মেসিকে জড়িয়ে ধরা...

ওসব ছবি জোড়া লাগিয়ে ফ্রেম তৈরি করা যায় চাইলে। তবুও স্বীকৃতির জন্য দরকার হয় জয়। কেন? ২০১৪ বিশ্বকাপের পর লিওনেল মেসির গোল্ডেন বলের ট্রফি আনতে যাওয়া ছবি প্রমাণ তার। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা শূন্যতা ব্যক্তিগত শিরোপায় মেটানো যায় না, অনুভব করা যায় তেমন।

সময় বয়ে চলে। ২০১৫ আসে, ‘১৬ও। তিন ফাইনাল হারের পর আলাভোলা ছেলেটি বলে ফেলেন, ‘আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমার আর কিছুই বাকি নেই...’। হৃদয় ভেঙে যায়। পৃথিবীজুড়ে শত কণ্ঠ জেগে উঠে ফিরে আসার আবদারে। তিনি আসেন।

শূন্যতার শোকসভার চেয়ারগুলো পূরণ হয় একে একে। কোথাও জীবনভর ‘বঞ্চনা’ পেরিয়ে আসা এমিলিয়ানো মার্তিনেস বসেন; ক্যারিয়ারের অর্ধেকই ক্লাবে ক্লাবে ধারে খেলতে খেলতে কেটে গেছে তার। কোথাও বসে রদ্রিগো দে পলের মতো বিশ্বস্ততা। ‘মেসির বডিগার্ড’ বা এমন কিছু শুনতেও আপত্তি থাকে না তার।

বন্ধু সার্হিও আগুয়েরোর ফুটবলের ইতি ঘটে যায় হৃদরোগে। তার জায়গা নেন আদর্শ মেনে বেড়ে উঠা হুলিয়ান। সাদা ঘরের দেয়াল কালো হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বড় হওয়া অথবা বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে না পারা আনহেল দি মারিয়ারাও যোগান ভরসা।  

সন্ধ্যা নামতেই তবুও নেমে আসে আধার। সৌদি আরবের কাছে হার! কোন সুদূরের বাংলাদেশও গভীর উদ্বেগ। এরপর ফুটবল অথবা লিওনেল মেসি এদেশের মানুষকে মিলিয়ে দেন আর্জেন্টিনায়ও।

একটা একটা করে ম্যাচ যায়, ‘ম্যাজিকাল মেসি’ ছাড়া মুখে বের হয় না তেমন কিছু। ধারাভাষ্য কক্ষের ভরাট কণ্ঠে পিটার ড্রুরি বলেন, ‘তারা (সৃষ্টিকর্তাকে) ধন্যবাদ দেয়, কারণ তিনি তাদের একজন...’। ভদ্রলোকের মনের কথা বলতে পারার ক্ষমতায় নিশ্চয়ই মুগ্ধ হন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব গুণমুগ্ধ।

একটু একটু করে এগিয়ে চলে মেসির পথচলা। নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে মেসি করেন এমন কিছু, যেটা দেখা যায় না সচরাচর। ‘ইডিয়ট’ বা এমন বলেন তিনি। সবাই যখন ছুটে যান একসঙ্গে উদযাপনে, মেসি তখন খুঁজে নেন বিশ্বস্ত সঙ্গী মার্তিনেসকে। তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েন নিজেও। মেসি তবুও নেতা নন!

দ্যুতি ছড়িয়ে মেসি গোল করেন ক্রোয়োশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে। দল পায় সহজ জয়। এরপর হাঁটুতে হাত দিয়ে কুঁজো হন মেসি। চারদিকে তাকান, হাসেন, মুখের অবয়বে ফুটে উঠে আনন্দ; স্বস্তি। মেসি কাঁদেনও কি না কে জানে!

লুসাইলে রোববার কী হবে? মেসি কি আরও একবার কাঁদবেন? এমবাপ্পে হাসবেন? চোখে জল পুরো পৃথিবীজুড়ে দেখা যাবে এবারও? প্যারিসে তাহলে উৎসবটা তো হওয়ারই কথা? পিএসজিতে কি হবে? এমবাপ্পের জন্য? মেসি তখন কোথায় লুকাবেন নিজেকে?

উত্তর জানা নেই কারও। হয়তো পুনারাবৃত্তি হবে ব্রাজিলের মারাকানার অথবা না। মেসির অপলক দৃষ্টিতে বিশ্বকাপ ট্রফিতে তাকিয়ে থাকার হৃদয় ভাঙা ছবি হয়তো স্থায়ীভাবে জড়ো হবে ইন্টারনেটে। রাজা সুখের খোঁজে বেড়িয়ে ফিরে আসবেন সন্নাসী হয়ে, হতে পারে তাও। অথবা লেখা হবে আলাভোলা ছেলেটির আলো ও আনন্দের গল্প।  

আচ্ছা, মেসি কি ‘বিলিভার’ গানটি শুনেছেন? ওই লাইনটা, ‘যন্ত্রণা! আমাকে বিশ্বাসী করে তুলে...’ যদি সত্যি হয় কথাগুলো; মেসির তো হারার কথা না। আর্জেন্টিনার এই যে বিশ্বকাপ ফাইনালে চলে আসা, স্কিলে? মনে হয় না তা। তাহলে? বিশ্বাসে। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, আরেকবার কি বিশ্বাসী হবেন? অথবা আরেকবার শেষ বাঁশি বাজার পর হাসি? অন্তত কাঁদবেন না, প্লিজ!

বাংলাদেশ সময় : ১১৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২২
এমএইচবি/এআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।