ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বে রক্ষা পাচ্ছে বিপন্ন ‘বহেরা’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৯
জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বে রক্ষা পাচ্ছে বিপন্ন ‘বহেরা’

মৌলভীবাজার: ‘বায়োডায়ভারসিটি’ অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য শব্দটির গুরুত্ব থেকে রক্ষা পাচ্ছে বিপন্ন প্রাকৃতিক উদ্ভিদগুলো। এদেরই অন্যতম ‘বহেরা’। এক সময় বন্যপ্রাণীর জন্য এ উদ্ভিদগুলো অত্যন্ত উপকারী হলেও অপ্রয়োজনীয় কাঠ হিসেবে কেটে ফেলতো বন বিভাগ। 

কিন্তু ১৯৯২ সালের পর ‘বায়োডায়ভারসিটি’ শব্দটি আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক গুরুত্ব পেলে প্রকৃতির এই গাছগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা পায়। এর প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়ে।

প্রকৃতির সমস্ত উপাদানগুলো সংরক্ষণ করে টেকসই প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলা এই বায়োডায়ভারসিটি ধারণারই অংশ।  

পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকেই তখন আমাদের দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল সংরক্ষণের আওতায় চলে এলো এবং এর ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন মূল্যবান বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার সুযোগ পেয়েছে।    

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও উদ্ভিদ গবেষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ত্রিফলা’র একটি ফল হলো বহেরা। অর্থাৎ হরিতকি, আমলকি আর বহেরা- এই তিনটি ফল মিলে হলো ত্রিফলা। ত্রিফলা একত্রে খেলে সর্বরোগের উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া বহেরা আমাশয়, ডায়ারিয়াসহ পেটের সব ধরনের সমস্যার ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এটি আবার শক্তিবর্ধক।  

বহেরা বন্যপ্রাণীদের খাবার। মূলত এটি হরিণের প্রিয় খাবার। এটি আমাদের ফরেস্টের গাছ। এক সময় প্রচুর ছিল। কিন্তু নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে এ বৃক্ষটি এখন আমাদের প্রাকৃতিক বন থেকে অনেক কমে গেছে। আর যেহেতু ফল কালেক্ট (সংগ্রহ) করে ফেলে তাই এর রিজেনারেশনও (পুনর্প্রজন্ম) হয় না। এর ছোট চারা দেখা খুবই কঠিন। এই বৃক্ষের স্ট্যাটাসটা এখন ‘বিপন্ন’ বলা যেতে পারে। কারণ একে আপনি সহজে আর বনে দেখতে পাবেন না বলে জানান প্রফেসর জসীম উদ্দিন।  

বিপন্ন ওষুধি ফল বহেরা।  ছবি: ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনবনায়ন সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, এখন সরকার বিভিন্ন বনে কৃত্রিমভাবে চাষ করে বহেরা লাগিয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বনে এর উপস্থিতি এখন কম। কারণ এটি আগে টিমবারের (কাঠ) কাজে লাগানো হতো না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাজ তো হলো টিম্বার গাছগুলোর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। সুতরাং, এ গাছটি টিম্বার হিসেবে ম্যানেজমেন্টের (ব্যবস্থাপনা) আওতায় না আসাতে তখন এটি বাজে গাছ হিসেবে কেটে ফেলা হয়েছে। আগে ফরেস্টের পলিসি (কৌশল) ছিল যে, সব গাছ ভালো টিম্বার (মূল্যবান কাঠ) দেবে সে গাছগুলোকে তারা গুরুত্বসহকারে রক্ষাণাবেক্ষণ করবে। কয়েক বছর আগে বহেরা ফরেস্ট ম্যানেজমেন্টের তালিকাভুক্ত গাছ না থাকায় এগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। টিম্বারের বাইরের কোনো কম্পনেন্ট (উপাদান) তখন তাদের আওয়াভুক্ত ছিল না।   

‘১৯৯১ এর পরে যখন ‘বায়োডায়ভারসিটি’ শব্দটা এলো তখন বায়োডায়ভারসিটি কনসেপ্টটা (ধারণা) ব্যাপকভাবে গুরুত্ব লাভ করলো। এরই রেশ ধরে ফরেস্টের ম্যানেজমেন্ট পলিসি পরিবর্তিত হলো এবং বলা হলো যে, ফরেস্টে সব ধরনের কম্পনেন্ট ম্যানেজমেন্টে থাকতে হবে। তখন সরকার ফরেস্ট পলিসি চেঞ্জ করে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ গঠন করা হয় এবং যার ফলে বনের প্রত্যোকটা গাছপালা-পশুপাখি সংরক্ষণের আওতায় চলে এলো। ’ 

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে প্রফেসর জসীম উদ্দিন বলেন, ১৯৯২ সালে ব্রাজিলে যে পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হলো যেখানে দু’টি জিনিস বের হয়ে এলো: একটা হলো সিবিডি (কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডায়ভারসিটি) এবং অপরটি এজেন্ডা ২১। এ দু’টিই হলো আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই দু’টি দলিলেই কিন্তু বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল। যেখানে বলা হয়েছে যে, সবার নিজ নিজ দেশের ডায়ডারসিটি রক্ষা করবে, সাসটেনেবল (টেকসই) ব্যবহার নিশ্চিত করবে এবং মেডিশনাল (ওষুধি) গুণ রিসোর্স (গবেষণা) থেকে কোনো ধরনের বেনিফিট (উপকার) বের হয়ে এলে এর ইকুইটেবল শেয়ারিং নিশ্চিত করতে হবে।

যেমন- আপনার একটা ওষুধি গাছ আছে, যেখান থেকে কোনো উপকার এলো, এখন যে গবেষণা করবে এবং যার গাছ এ দু’জনের ভেতর শেয়ারিং নিশ্চিত করতে হবে। এর লাভটা বের করে দিতে হবে। তখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলা হলো যে, বায়োডায়ভারসিটির কোনো কম্পনেন্ট আর ধ্বংস করা যাবে না এবং এগুলোকে রক্ষা করতে হবে, সাসটেনেবল ইউজ (টেকসই ব্যবহার) করতে হবে, এর থেকে কোনো বেনিফিট বের হলে তার সমান অশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলেই আমাদের বনের সব উপদান রক্ষা করার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব পেলো।  
   
উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, যেমন ধরেন চা। একটি উন্নতজাতের ভালো চা বাংলাদেশ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের দেশের চা পৃথিবীর অন্য দেশে বিক্রি হচ্ছে না। এটি তো একটি পাতার রস। এখান থেকে যত বেনিফিট (উপকার) বের হবে গাছ যদি বাংলাদেশের হয় তবে বাংলাদেশকেও এর শেয়ার দিতে হবে। যেমন ধরেন ওষুধি উদ্ভিদ বহেরা। এখন থেকে যদি একটি বেনিফিট বাণিজ্যিকভাবে বের হয় এবং গাছটি যদি বাংলাদেশের হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তবে বাংলাদেশকে শেয়ার দিতে হবে।  

বহেরা সম্পর্কে তিনি বলেন, এর বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia bellirica (টারমিনেলিয়া বেলিরিকা) । বহেরা গাছ প্রায় ত্রিশ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গোড়া থেকে খাঁড়া একটি অংশ হয়। উপরে গিয়ে ছড়িয়ে যায়। আর ফুলটা নিচের দিকে জোলানো থাকে। ফুলগুলোর রং হলুদ। ফলটাতে বাদামি রঙের আবরণ থাকে। ফলের ভিতরে বাদামের মতো একটি সাদা অংশ থাকে।  

জেনেটিক ডায়ভারসিটি, পিসেস ডায়ভারসিটি, কালচালের ডায়ভারসিটি, ইকোসিন্টেম ডায়ভারসিটি পৃথিবীর এ সবকিছুই হচ্ছে ‘বায়োডায়ভারসিটি’ অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যের অর্ন্তভুক্ত বলে জানান উদ্ভিদ গবেষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৯
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।