ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পরিবেশগত ছাড়পত্র হালনাগাদ নেই তবুও চলছে ইটভাটা

বদরুল আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
পরিবেশগত ছাড়পত্র হালনাগাদ নেই তবুও চলছে ইটভাটা ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে ইট।

হবিগঞ্জ: জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় কুর্শি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দ খালেদুর রহমানের ‘গোল্ড ব্রিকস’ নামে ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকায় অবৈধ হিসেবে লিপিবদ্ধ। তারপরও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিয়মিত ভাটা চালু রেখে ইট উৎপাদন করছেন তিনি।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে উল্লেখ আছে- অন্য যেকোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।

তা অমান্য করে হবিগঞ্জ জেলা যুবলীগ সভাপতি, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলার পলাতক আসামি আবুল কাশেম চৌধুরীর ইটভাটা ‘আবিদ-আতিয়া ব্রিকস’ চলছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির কেন্দ্রবিন্দুতে। ভাটার চারদিকে বোরো ধানের জমি, কয়েকশ ফুট দূরেই বানিয়াচং উপজেলার বলাকিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রত্না বাজার। এসব স্থানে প্রতিনিয়ত ধুলোবালি উড়ে পড়ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকায় অবৈধ হিসেবে লিপিবদ্ধ আরও তিনটি ইটভাটা হচ্ছে, নবীগঞ্জ উপজেলার বাংলাবাজারে ‘মাস্টার ব্রিকস’, বাহুবল উপজেলার মিরপুরে ‘রবিন ব্রিকস’ এবং একই উপজেলার বসিনা এলাকার নিউ রয়েল ব্রিকস।

এগুলোর ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ চারটি ইটভাটা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনে চিঠি পাঠানো হয়েছে; কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র হালনাগাদ না থাকা সত্ত্বেও ইটভাটাগুলো চালানো হচ্ছে।

এদিকে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলার গ্রাম ও শহরে মোট ১১৯টি ইটভাটার মধ্যে ৩০টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই এবং ৫০টির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে আরও আগেই।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভাষ্য—  পরিবেশগত ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া ২৬টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। অবৈধ ৪টি ইটভাটা এখনও চলমান। কিন্তু এগুলো বন্ধে জেলা প্রশাসনে চিঠি পাঠানো হলেও কাজ হয়নি।

তবে স্থানীয় সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তর যে ২৬টি ইটভাটা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে তার অধিকাংশই এখন পুরোদমে চলমান আছে। নিয়মিত ইট উৎপাদন করে বিক্রয় করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া ৩০টি ইটভাটার মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় চারটি, চুনারুঘাটে ছয়টি, মাধবপুরে চারটি, নবীগঞ্জে চারটি, লাখাইয়ে একটি, বাহুবলে ১০টি ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় একটি।

সরেজমিনে দেখা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি থেকে মাধবপুর উপজেলার আন্দিউড়া পর্যন্ত এলাকায় ইটভাটার অধিকাংশ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে ফসলি জমি ও বনাঞ্চলের আশপাশে গড়ে উঠেছে। এসবের আশপাশেই রয়েছে রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক। যা ইট প্রস্তুত আইন পরিপন্থি।

বাহুবল উপজেলার হাসপাতাল এলাকায় ‘নাসিম ব্রিকস’ নামে একটি ইটভাটা রয়েছে। অথচ পরিবেশ আইন অনুযায়ী হাসপাতালের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ভাটা স্থাপন করা যাবে না। আশ্চর্যজনকভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকায় ওই ইটভাটার ঠিকানাও উল্লেখ রয়েছে ‘হাসপাতাল এলাকা’।

অন্যদিকে ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী ও নানা রাজনৈতিক পদে থাকায় লোকালয়ের ভেতর দিয়েই ট্রাক্টরে করে মাটি আনা নেওয়া করা হচ্ছে। কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। মাটি আনা নেওয়ার ফলে ধুলোবালি উড়ে চলাচলকারী লোকজনের চোখেমুখে পড়ছে। লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভাটার কালো ধোঁয়া। এতে নিয়মিত বায়ুদূষণ ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। তাই, লাইসেন্স এবং ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ইটভাটা পরিচালনা করা যাবে না। ’

তারপরও হবিগঞ্জে বেআইনি ইটভাটাগুলো কীভাবে চলছে? প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে বলেন, ‘পরিবেশের সুরক্ষা বিবেচনা করলে হবিগঞ্জ জেলায় একটি ইটভাটাকেও চলতে দেওয়া যাবে না। তারা ইউনিয়ন পরিষদসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে কাগজপত্র তৈরি করে পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়েছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব ইটভাটার বেশিরভাগই কৃষিজমি, পাহাড় ও বনাঞ্চলের আশপাশে। অনেক ইটভাটার এক কিলোমিটারের ভেতরেই অবস্থিত স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানসহ জনবসতি। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন স্বোচ্চার না হলে অবৈধ ইটভাটাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ’

এ ব্যাপারে ইটভাটার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন সংক্রান্ত দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার সন্দ্বীপ তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, অনেক ইটভাটার মালিক লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ধান উৎপাদনে বড় আঘাত
জেলার বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটার অপরাধে প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালতে লোকজনকে সাজা দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু জমির মাটি কাটা থামছে না। আর এসব মাটির বেশিরভাগই যাচ্ছে ইটভাটাগুলোতে। যুবলীগ সভাপতি আবুল কাশেমের ইটভাটায় মাটি নেওয়া হচ্ছে পাশের বোরো জমি থেকে।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একেএম মাকসুদুল বলেন, জমির উপরিভাগের ৬ ইঞ্চি মাটি থেকে প্রধানত ধান ও শাকসব্জি জাতীয় ফসলগুলো পুষ্টি গ্রহণ করে। বোরো ও আমনের জমি থেকে এসব মাটি কেটে নেওয়ায় জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। জমির এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বহুবছর প্রয়োজন। টপসয়েল কাটা বন্ধ না হলে ধান উৎপাদনে বিপর্যয় নামবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।