অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে বেশ তোড়জোড় শুরু করে। সুপারশপে পলিথিন বন্ধের পদক্ষেপ প্রায় সফল।
এমন প্রেক্ষাপটে পরিবেশসম্মত ব্যাগ উৎপাদনে এগিয়ে এসেছেন বেশ কিছু উদ্যোক্তা। কিন্তু তারা কারখানা স্থাপনের পর বর্তমানে অসহায়। ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে তৈরি ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতিই পাচ্ছেন না তারা। ঘুরতে হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্বারে দ্বারে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উদ্যোক্তাদের নানা অজুহাত দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত তিনজন উদ্যোক্তা ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে বায়ো ডিগ্রেডেবল বা পচনশীল ব্যাগ তৈরি করতে আগ্রহী। কিন্তু তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও তারা এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাননি। এর মধ্যে রয়েছে রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তিন বছর ধরে ঘুরেও ভুট্টার স্টার্চে তৈরি ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে গোপালগঞ্জের জে কে পলিমার নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপন করেছে। এখন চলছে ট্রায়াল। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাসখানেক আগে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করে এখনো ছাড়পত্র পায়নি।
বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেকের স্বত্বাধিকারী ইফতেখারুল হক বলেন, আবেদন করার পর প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে।
তিন বছর ধরে ঘুরেও ভুট্টার স্টার্চে তৈরি ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে গোপালগঞ্জের জে কে পলিমার নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান কারখানা স্থাপন করেছে। এখন চলছে ট্রায়াল। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাসখানেক আগে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করে এখনো ছাড়পত্র পায়নি।
বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেকের স্বত্বাধিকারী ইফতেখারুল হক বলেন, ‘আবেদন করার পর প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আমাদের ছাড়পত্র দেয়নি। আমাদের আবেদনপত্রটি নাকি বর্তমানে ঢাকায় আছে। কিসের জন্য ছাড়পত্র দিচ্ছেন না, উনারাই ভালো জানেন। একেক সময় একেক ধরনের অজুহাত দেখাচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে। আমি পরিবেশের জন্য কাজ করছি, অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পাচ্ছি না। আমাদের কারখানা থেকে কোনো বর্জ্য নির্গত হয় না, সবুজ ক্যাটাগরির অন্তর্গত। আমাদের এই ব্যাগ পরিবেশসম্মত। মাটিতে এক মাসের মধ্যে পচে যায়। ব্যাগে ব্যবহৃত উপাদান মাটির ক্ষতিও করে না। কিন্তু তার পরও আমরা কেন ছাড়পত্র পাচ্ছি না তা আমার বোধগম্য নয়। ’
এই অধিদপ্তর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। যার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। বিকল্প হিসেবে কাগজ, পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের দিতে হবে। আর ১ নভেম্বর থেকে খুচরা বাজারেও এসব ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। সেই ঘোষণা অনুযায়ী দেশের বেশির ভাগ সুপারশপই সরকারের ওই নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করছে।
কিছুদিন আগে রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, ‘পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ এবং নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে। এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। পলিথিন উৎপাদনকারীদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পাট-চট দিয়ে আমরা পলিথিনের বিকল্প করব। তাহলে আমাদের দেশীয় শিল্প উঠে আসবে। বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগ (উৎপাদনকারীদের) নিয়ে আমরা বসব। এবং এটাকে সনদ দেওয়া যায় কি না আমরা সেটা দেখব। সনদ ছাড়া মার্কেটে এটাকে ঢুকতে দেব না। পাট আর চট নিয়ে কেন অনীহা?’
তবে বর্তমানে যারা পাটের ব্যাগ তৈরি করছেন, তাদের মধ্যে একজন উদ্যোক্তা জানান, বাজারে পর্যাপ্ত পাট পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাগের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তা পাটের অভাবে প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে পলিথিনের ব্যবহার কমাতে খুচরা বাজারে তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, খুচরা বাজারে বাড়েনি পলিথিনের দাম। কমেনি সরবরাহ। আর ভুট্টার স্টার্চ দিয়ে যেসব উদ্যোক্তা পরিবেশসম্মত ব্যাগ তৈরিতে কারখানা স্থাপন করছেন, তারা পাচ্ছেন না পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
গোপালগঞ্জের জে কে পলিমারের প্রডাকশন ম্যানেজার মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘কারখানা স্থাপন করেছি। কিন্তু এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি পাইনি। ফলে উৎপাদন বন্ধ আছে। বর্তমানে কারখানার ট্রায়াল চলছে। বিএসটিআই থেকে আমাদের ব্যাগ পরীক্ষা করবে। এ জন্য দুই-তিন মাস সময় লাগবে বলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেছি, উনারা দেড় মাস সময় নিয়েছে। ঢাকার পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। কর্মকর্তারা বলেছেন সময় লাগবে। টেস্ট করতে হবে। ’
অন্যদিকে চট্টগ্রামের আর্থ ম্যাটারস লিমিটেড ভুট্টার স্টার্চের তৈরি পচনশীল ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। তাদের ব্যাগ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায় গার্মেন্ট পণ্যের প্যাকেট হয়ে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রির অনুমতি পায়নি। এ নিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে তারা বৈঠক করেছেন। এই ব্যাগ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া যায় কি না তা দেখবেন বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা।
আর্থ ম্যাটারস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ আনোয়ারুল আলম বলেন, ‘আমাদের এই ব্যাগ তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পরীক্ষা করা হয়। বুয়েট পরীক্ষায় ৯ ধরনের পদার্থের উপস্থিতি পরীক্ষা করে, যা আমেরিকান মান অনুযায়ী সর্বোচ্চ উপস্থিতির চেয়ে অনেক কম মাত্রায় রয়েছে। সুতরাং এই ব্যাগ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের বাজারে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া উচিত। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদিত ব্যাগের দাম তিন থেকে ১৫ টাকার মধ্যে। ’
অন্ধকারে সোনালি ব্যাগের উৎপাদন
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীর আবিষ্কার করা পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি সোনালি ব্যাগ এখনো অন্ধকার থেকে আলোর মুখ দেখেনি। এ জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে এই প্রযুক্তি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দিতে প্রয়োজনীয় যে নীতিমালা দরকার তা-ও এখনো করা হয়নি। ফলে অন্ধকারেই রয়ে গেছে সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন।
বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমেদ খান বলেন, ‘সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ পাইনি। মেশিনপত্রও কিনতে পারিনি। চলতি মাসে সরকারের পক্ষ থেকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে। টাকা না পেলে তো আমার কিছু করার নেই। সরকার যদি টাকা না দিয়ে বেসরকারি খাতে দেয়, সেটাও বলেছি যে এর জন্য একটি নীতিমালা করে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হোক। অনেক দেশি-বিদেশি কোম্পানি আগ্রহী আছে। সেটাও হচ্ছে না।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘পলিথিন আমাদের ভয়ংকরভাবে ক্ষতি করছে। ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের সমান আকারের স্তূপ আছে সমুদ্রে। এতে সামুদ্রিক মাছ মারা যাচ্ছে। আমাদের শরীরে প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক জমা হচ্ছে। ফসলের উর্বরতা নষ্ট করে দিচ্ছে। এই পলিথিন মাটিতে পচতে ৫০০ থেকে ১০০০ বছর লাগে। ১০ বছর পর কী ভয়ংকর পরিস্থিতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা জানি না। যেকোনোভাবে আমাদের এই প্লাস্টিকের ব্যাগ বন্ধ করতে হবে। ৪০ বছর আগে এই ব্যাগ ছিল না, তখন কী আমরা বাজার করিনি?’
তিনি বলেন, ‘পলিথিন উৎপাদনে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের পাটের কারখানায় কাজে লাগানো যাবে। বিকল্প ব্যাগ যারা উৎপাদন করবেন, সেখানে এই শ্রমিকরা কাজ করতে পারবেন। অন্যদিকে দামে যদি সাশ্রয়ী হয় এবং ভারী ধাতু যদি সহনশীল মাত্রায় থাকে, তাহলে ভুট্টার স্টার্চ থেকে ব্যাগ উৎপাদনের অনুমতি দিতে কোনো ক্ষতি তো দেখছি না। ’
বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ভুট্টার স্টার্চ থেকে তৈরি ব্যাগের ছাড়পত্রের বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২৫