আমাদের চারপাশের গাছগুলোর কথা বলছি। প্রাণিজগতের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ‘উপাদান’ হওয়া সত্ত্বেও গাছদের ব্যাপারে আমরা একেবারেই অমনোযোগী।
আমাদের পরম যত্নে ঘিরে থাকা গাছরা বেড়ে উঠছে চরম অযত্ন, অবহেলায়; মারা যাচ্ছে অকালে। গ্রামের তুলনায় শহরের গাছের ‘অপমৃত্যু’ কিংবা ‘অকালমৃত্যু’ হয় বেশি। ইংরেজিতে একটি কথা আছে— আরবান ট্রিস ডাই ইয়াং। অনেক গবেষক দাবি করেন, শহরের প্রায় ৫০ শতাংশ গাছপালাই অকালে মারা যায়। এই দাবি যদি সত্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ৬০-৭০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি হবে। কিন্তু, শহরের গাছগুলো তাড়াতাড়ি মারা যায় কেন?
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে গাছপালা তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রাস্তার পাশে বা আইল্যান্ডের গাছের গোড়ায় মাটি কম থাকা, গাছের পাতায় ধুলোবালির আস্তরণ পড়ে সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রাস্ত হওয়া, ইলেকট্রিক লাইন সমান উচ্চতায় পৌঁছানোর আগেই অকাতরে কেটে ফেলা, ডালপালার কারণে পার্শ্ববর্তী বাসায় আলো না পৌঁছালে বা সাইনবোর্ড/বিলবোর্ড ঢেকে ফেললে ‘ন্যাড়া’ করে কেটে ফেলা, মাটির নিচে গ্যাস লিকের অজুহাতে সমূলে উৎপাটন, বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে গাছের গায়ে নির্বিচারে পেরেক ঠোকানো ইত্যাদি। এছাড়াও ঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ঝুঁকিপূর্ণ গাছ আগেভাগে কেটে ফেলা নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের অংশ।
উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে শহরের গাছগুলোর প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়াতে গেলেই তা চোখে পড়বে। আমি ঢাকা এবং কলকাতা ছাড়া আর কোনো শহরেই গাছের প্রতি এমন অবহেলা-অযত্ন দেখিনি। আমরা যেভাবে গাছের গায়ে লোহা, পেরেক, দড়ি ও তার দিয়ে সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন, ব্যানার লাগাই, পৃথিবীতেই বিরল। এই শহরে আনমনে কোনো গাছের দিকে তাকিয়ে গাছের পাতা, ফুল, ফল কিংবা পাখি দেখতে পাওয়ার বদলে আমরা দেখতে পাই ‘পড়াতে চাই’, ‘পাত্র-পাত্রী চাই’, ‘বাসা ভাড়া দেওয়া হবে’, ‘ভর্তি চলছে’ ইত্যাদি চটকদার শিরোনামের বিজ্ঞাপন। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণই যদি গাছের গায়ে এমন বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে সেটা বিজ্ঞাপনদাতার গায়ে লাগিয়ে প্রচার করলেই বরং অধিক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে বলে মনে করি। গাছদের প্রতি এমন ব্যবহার সভ্যতা বিবর্জিত, ধ্বংসাত্মক এবং পরিবেশ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
গাছ কি কেবলই আমাদের অক্সিজেন দেয়? না, শহর এলাকার গাছ ছায়ার পাশাপাশি তাপমাত্রা কমাতেও সাহায্য করে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে দূষণ কমায়, শোভাবর্ধন করে এবং গাছ থেকে আমরা ফুল, ফল, এমনকি ওষুধও পাই। কিন্তু, বিনিময়ে আমরা গাছকে কী দিই? নিরাপদে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তাটুকুও কি দিতে পারি? লোক দেখানো কাজের অংশ হিসেবে অনেকে গাছ লাগানোর ভান ধরলেও গাছ বাঁচানোর দায়িত্ব কেউই নিচ্ছে না; এমনকি ভানও করছে না!
এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে আমাদের করণীয় কী? সচেতনতা! আপনার আশেপাশে কোথাও এরকম কিছু হতে দেখলে এগিয়ে আসুন। আমাদের এক এক করে এগিয়ে যাওয়াই অনেক এগিয়ে যাওয়ার সমান। নিজে এমন কাজ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করুন এবং অন্যকেও নিরুৎসাহিত করুন। কাজের বিরোধিতা থেকেই অভ্যাসের পরিবর্তন আসবে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা দেয়াল লিখন খারাপ চোখে দেখেন বা ঘৃণা করেন। একইভাবে গাছের গায়ে কোনোকিছু লাগানোকেও ঘৃণা করতে হবে। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যারা গাছের গায়ে এগুলো লাগানোর কাজ করেন, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও সচেতনতার অভাব থাকতে পারে। কিন্তু, যারা এমন কাজের উদ্যোগী, তাদের বোধোদয় কি আমরা আশা করতে পারি না?
আমি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে চাই এ বিষয়ে তার প্রচণ্ড আগ্রহের জন্য। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য তিনি পরিবেশ ও বন বিভাগকে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করেছেন। এভাবে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশ ও সেবামূলক কাজগুলো এগিয়ে নিলেই দেশ বদলাবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, দয়া কিংবা মানবিকতা থেকে নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই আমাদের চারপাশের গাছগুলোকে রক্ষা করতে হবে। শহর কিংবা গ্রাম— সব জায়গাতেই গাছদের নিরাপদে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে। গাছদের সুরক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা নাগরিক জীবনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে অকালে মারা না যায়। গাছের গড় আয়ু বাড়াতে ভূমিকা রাখতে হবে না, অন্তত আমরা বা আমাদের কর্মকাণ্ড যেন তাদের অকালমৃত্যু কিংবা অপমৃত্যুর কারণ না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখলেই হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকা গাছদের বেঁচে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গাছদের অকালমৃত্যু কি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি নয়?
লেখক ব্র্যাক ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড চিফ অপারেটিং অফিসার। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর এক্সিকিউটিভ সার্টিফিকেশন সম্পন্ন করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪
আরআইএস