ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

সংসদ নির্বাচন ইভিএমে হবে না, যন্ত্রগুলো কী করবে ইসি

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
সংসদ নির্বাচন ইভিএমে হবে না, যন্ত্রগুলো কী করবে ইসি ইভিএম। ফাইল ছবি

ঢাকা: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করার পরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে কয়েক হাজার কোটি টাকার মেশিনগুলো দিয়ে কী করবে তার পথও খুঁজছে সংস্থাটি।

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক বিতর্ক থাকায় এবং এই মেশিনের ব্যবহার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য থাকায় জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিতে চায় না কমিশন। তাই বলে কয়েক হাজার কোটি টাকার মেশিন তো বাতিল করে দেওয়া যায় না। এজন্য স্থানীয় নির্বাচনে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনাও ফেলে দিচ্ছে না কমিশন। তবে এক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। সেটি হচ্ছে ইভিএম প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ। তাই নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মেশিনগুলো রক্ষণাবেক্ষণই এখন আসল চ্যালেঞ্জ।

জানা গেছে, এক-এগারোর সরকারের সময়কার ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে মেশিন তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোট যন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরবর্তীতে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূল্যের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে উন্নত মানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়।

২০১৭ সালে কে এম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্বে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেন তারা। এতে মেশিন প্রতি ব্যয় হয় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। হাতে নেওয়া হয় তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প।

সেই প্রকল্প থেকে দেড় লাখ ইভিএম কেনে রকিব কমিশন। প্রকল্পের সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ব্যবস্থা না থাকায় সেই উন্নত মানের ইভিএমের মেয়াদ ১০ বছর হলেও পাঁচ বছর যেতে না যেতেই অকেজো হওয়া শুরু করে। কন্ট্রোল ও ব্যালট ইউনিট মিলে একটি সেট, যা একটি ইভিএম হিসেবে ধরা হয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এসে প্রায় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অবশিষ্ট এক লাখ ১০ হাজার মেশিনের মধ্যে অধিকাংশগুলোতে ধরা পড়ে নানা ধরনের ত্রুটি। কিন্তু মেরামতের জন্য ছিল না নতুন কোনো অর্থের জোগান। এর ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলে বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। বর্তমানে অকেজো ইভিএমের সংখ্যা আরও বেড়েছে। সচল মেশিনগুলো তাই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রকল্পের অর্থ ছাড়া মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে সরকার ইসির সেই প্রস্তাবও সম্প্রতি নাকচ করে দেয়। ফলে প্রকল্পটির এক্সিট প্ল্যান করছে ইসি।

ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, বর্তমানে এক লাখ ১০ হাজার মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী। আর ৪০ হাজারের মতো মেশিন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে।

তিনি বলেন, আসল কথা হলো দক্ষ লোকবলের অভাব। আমাদের প্রকল্প থাকলেও সেখানে দক্ষ কারিগরি লোকবল ছিল না, যারা ছোটখাটো সমস্যা হলে সমাধান করতে পারতেন। আগেও যে ইভিএম ছিল তখনো কারিগরি লোকবল নিয়ে ভাবনা হয়নি। এখনো নেই। এছাড়া সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি প্রকল্পে। বর্তমানে প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ায় এক্সিট প্ল্যান করা হচ্ছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, এক্সিট প্ল্যান করা হলেও রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলো নষ্ট না করে তা সংরক্ষণের যথাযথ উপায় খোঁজা হচ্ছে। এজন্য ওয়্যারহাউজ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমের পাশাপাশি ইসির বিদ্যমান ভবনগুলো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ইভিএম সংরক্ষণের জন্য অঞ্চলভিত্তিক ওয়্যারহাউজ তৈরির খসড়া ডিজাইন, জমি এবং অন্যান্য ব্যয়ের প্রাক্কলন দিতে মাঠ কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক ১০টি অঞ্চল তথা ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহীর মধ্যে সম্প্রতি ঢাকায় একটি ওয়্যারহাউজের কথা ভাবা হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে জমি চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য রয়েছে। এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মেশিন, এগুলোর কী হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তো এভাবে নষ্ট করা যায় না। অনেক সময় স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চাহিদা থাকে। এজন্য আমরা মেশিনগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের জন্য ভাবছি।

তিনি বলেন, প্রকল্প নেই। সেটার মেয়াদও বাড়েনি। এখন মেশিন সংরক্ষণে টাকা তো লাগবে। আর সেটা সরকারই দেবে। এছাড়া আর কে দেবে। প্রকল্প হোক বা সরকারি তহবিল থেকে অর্থ তো দেবে। আমরা সে উদ্যোগ নেবো।

ইভিএম ব্যবহার নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা আগামী নির্বাচনের কথা শুধু চিন্তা করছি না। অনেক অন্যায়, অপকর্ম হয়েছে অতীতে, এগুলো যাতে বন্ধ হয়, নির্বাচন ব্যবস্থা যাতে কার্যকর হয়, তার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে দীর্ঘমেয়াদে শক্ত হয় সেই ব্যবস্থা করবো।

তিনি বলেন, ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ, দুর্বল যন্ত্র ছিল। এগুলো এখন অকেজো হয়ে গেছে বোধ হয়। সবচেয়ে বড় কথা এটার জন্য রাজনৈতিক ঐক্য এবং আস্থাশীলতা দরকার। রাজনীতিবিদকেই এ বিষয়ে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত হবে।

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ইতোমধ্যে বলেছেন, ইভিএম অনেক ঝামেলার। আমরা এ ঝামেলার মধ্যে যাব না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালটে করারই পরিকল্পনা আমাদের।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
ইইউডি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।