ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

রমজানে চড়া মাছ-মসলার বাজার

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৩
রমজানে চড়া মাছ-মসলার বাজার

ঢাকা: গত কয়েক মাস ধরে হু হু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম যেন কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না।

এর ওপর রমজান আসায় প্রতি বছরের মতো অলিখিত নিয়মে আরেক ধাপ বাড়লো সবজিসহ প্রতিটি পণ্যের দাম। এতে দিশেহারা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।

রোববার (২৬ মার্চ) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ছুটির দিনে অনেকেই বাজার করতে এসেছেন। তবে সবজি, মাছ, মসলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের আকাশ ছোঁয়া দামের কারণে প্রয়োজনের তুলনায় কম বাজার করেই বাড়ি ফিরছেন তারা।

ক্রেতাদের অভিযোগ, রমজান মাস এলেই বিক্রেতারা ইচ্ছে করে সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দেন। পবিত্র এ মাসে তারা মানবিক হওয়ার পরিবর্তে যেন আরও বেশি অমানবিক হয়ে উঠেন। তাই চাহিদা থাকলেও সামর্থ্য না থাকায় বাজারও করতে হচ্ছে তাদের।

বিক্রেতাদের দাবি, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার রমজানে কোনো পণ্যের দামই খুব একটা বাড়েনি। স্বাভাবিকভাবে দাম যেমন উঠানামা করে তেমনি উঠানামা করছে।

বিক্রেতারা দাবি যাই করুক, সরেজমিনে কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, রমজান ঘিরে প্রায় প্রতিটি সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। দুই একটি সবজির দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে দুই-একটি সবজির দাম কমেছেও বটে।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি মরিচ মানভেদে ৫০-৮০ টাকা, বরবটি ৮০-৮৫ টাকা, মারফা ৭০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, মূলা ৬০ টাকা, শিম ৭০-৮০ টাকা, পটল ৬০-৬৫ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, বেগুন ৭০ টাকা, কাঁচা পেঁপে ৪০ টাকা, সজনে ডাটা ১০০-১২০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, লতি ৯০ টাকা, কচুরমুখী ১২০-১৬০ টাকা, লাল আলু ৪০ টাকা, গাজর ৪৫-৫০ টাকা, কাঁচা আম ১৬০ টাকা, টমেটো ৪০-৪৫ টাকা, কুমড়া ৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি পিস ফুলকপি ৭০ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ টাকা, চাল কুমড়া ৩০ টাকা, ব্রকলি ৬০ টাকা, লাউ ৮০ টাকা, ক্যাপসিকাম ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচাকলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা।

অথচ রমজান মাস শুরুর আগে, অর্থ্যাৎ এক সপ্তাহ আগে এই একই বাজারে প্রতি কেজি মরিচ মানভেদে বিক্রি হয়েছিল ৪০-৫০ টাকা, বরবটি ৬০-৬৫ টাকা, মারফা ৫০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, মূলা ৫০ টাকা, শিম ৩০-৩৫ টাকা, পটল ৭০-৭৫ টাকা, ঢেঁড়স ৭০-৭৫ টাকা, বেগুন ৫০-৬০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, সজনে ডাটা ১৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা, কুমড়া ৪০ টাকা, লাল আলু ২৫-৩০ টাকা, কাঁচা আম ১৫০ টাকা, টমেটো ৩০-৩৫ টাকা। এছাড়া ফুলকপি প্রতি পিস ৫০-৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা, চাল কুমড়া ২০ টাকা, ব্রকলি ৪০-৫০ টাকা, লাউ ৭০ টাকা, কাঁচকলা প্রতি হালি ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল।

অর্থাৎ, পটল, সজনে ডাটা ও কুমড়া ছাড়া কমেনি কোনো সবজির দাম, বরং বেড়েছে অন্য সবগুলোর।

সবজির এ বাড়তি দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ইমরান নামের এক বিক্রেতা জানান, সিজন শেষ হওয়ায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, মূলা এসব সবজির দাম বেশি। এছাড়া কাঁচামালের দাম তো প্রতিদিন একই থাকে না। একদিন বাড়ে আরেকদিন কমে।

মো. জাকির নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, রমজানের প্রথমদিন ৮০ টাকা করে বেগুন কিনে এনে বিক্রি করতে পারিনি। পরে পচে যাওয়া শুরু করলে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছে। প্রতি কেজিতে লোকসান হয়েছে ৪৫ টাকা। অন্যান্য বছর রমজানে বেগুন, মারফাসহ কিছু কিছু সবজির দাম যেভাবে বাড়ে, এবার সেভাবে বাড়েনি।

এদিকে ক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ ঠিক থাকলেও বিক্রেতারা ইচ্ছে করেই রমজানে সবজির দাম বাড়িয়ে দেন। সরকারের যথাযথ মনিটরিং না থাকায় প্রতি রমজানে একই চিত্র দেখা যায়।

বাজার করতে আসা তপন কুমার দাস নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিটি সবজির দাম বেড়েছে। সরকার আমদানি বন্ধ করলেই ব্যবসায়ীরা সবজির দাম বাড়িয়ে দেন। আবার আমদানি চালু করলে বলে, কৃষক মরে যাচ্ছে। অথচ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতার।

পারভীন আক্তার নামের এক গৃহীনি বলেন, প্রতিবারই রোজায় সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। রোজার আগে যে মারফা ২০-৩০ টাকায় কিনেছি, এখন তা ৭০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা তাতে ঢাকা শহরে টেকাই দায় হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আর সেটা দেখারও কেউ নেই।

সবজির দাম বাড়লেও বাড়েনি শাকের দাম। বর্তমানে কারওয়ান বাজারে প্রতি আঁটি লাউ শাক ৩০ টাকা, ডাটা শাক ১০ টাকা, লাল শাক ১৫ টাকা, পাট শাক ২০ টাকা ও কলমির শাক ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পুদিনা পাতা ১০ টাকা, ধনিয়া পাতা ১০-১৫ টাকা, বিলেতি ধনিয়া ১৫ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে।

তবে কিছুটা দাম কমেছে রমজানে চাহিদার শীর্ষে থাকা লেবুর। বর্তমানে প্রতি হালি কলোম্ব লেবু ৬০-৭০ টাকা, এলাচি লেবু ৭০-৮০ টাকা, কাগজি লেবু ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে দাম বেড়েছে কিছু কিছু মসলার। এক সপ্তাহ আগে ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা, ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। অপরিবর্তিত আছে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি রসুন। আমদানি করা রসুন কিছুটা কমে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়।

আলু সংরক্ষণের জন্য স্টোরগুলোতে মজুদ করায় দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

মসলার বাজারে গিয়ে আরও দেখা যায়, গত সপ্তাহে ৭৮৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দারুচিনি এখন ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া এলাচ ২ হাজার ৪০০ টাকা, লবঙ্গ ২ হাজার টাকা, গোল মরিচ ১ হাজার ৬০০ টাকা, জয়িত্রী ২ হাজার ২০০ টাকা, জয়ফল ৫০০ টাকা, স্টার ৭২০ টাকা, ধনিয়া ৪০ টাকা, সাদা জিরা ৫২০ টাকা, কলোজিরা ১৩০ টাকা, সাদা গোল মরিচ ১ হাজার ২০০ টাকা, সরিষা ৬০ টাকা, শুকনো মরিচ ২২০ টাকা, তেজপাতা ৪২০ টাকা, কিসমিস ৪৩০ টাকা, কাজু বাদাম ১ হাজার ২০০ টাকা, কাঠবাদাম ৫৮০ টাকা, পেস্তা বাদাম ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে গত দুই মাস অস্থিরতা বিরাজ করার পর স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে মুরগির বাজারে। বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার ২১০ থেকে ২৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা চারদিন আগেও ২৭০ থেকে ২৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল। অর্থাৎ চারদিনের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম কমেছে কেজিতে প্রায় ৮০ টাকা।

এছাড়া চারদিন আগে ৩৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকা। চারদিন আগে ৩৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া সাদা কক বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি পাকিস্তানি কক বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা, যা চারদিন আগেও ছিল ৪২০ টাকা। তবে ৩৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া লেয়ার এখন বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি।

দাম কমার বিষয়ে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের মুরগি বিক্রেতা বাবু জানান, আমরা পাইকারি বাজার থেকে মুরগি কিনে আনি। পাইকারি বাজারে দাম কমলে, আমরাও কম দামে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করতে পারি। পাইকারিতে দাম বাড়লে, আমরাও বাড়তি দামে বিক্রি করি। তবে এখন দাম পড়তির দিকে। আগামী কয়দিন পর দাম আরও কমতে পারে।

মুরগির দাম এখন কিছুটা কমলেও আবার রমজানের মাঝামাঝি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন কয়েকজন বিক্রেতা।

রমজানের শুরুতে মুরগির বাজারে স্বস্তি ফিরলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি ক্রেতারা। মো. জামাল হোসেন নামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বলেন, মুরগির দাম কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। ব্রয়লার মুরগির দাম ১৩০-১৪০ টাকা কেজি হলে সাধারণ মানুষের জন্য ঠিক হতো।  

বর্তমানে কারওয়ান বাজারে প্রতি পিস কবুতর ১৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। যা আগেও এই দামই ছিল। তবে পিস প্রতি ১০০ টাকা কমেছে হাঁসের দাম। বর্তমানে প্রতি পিস হাঁস আকারভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মুরগির দাম কমলেও অপরিবর্তিত আছে চালের বাজার। কারওয়ান বাজারের পাইকারি চালের বাজারে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭২ টাকা, নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা, পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা, স্বর্না বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকা, আটাশ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা, পোলাও এর চাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা।

চালের বাজার অপরিবর্তিত থাকলেও কেজিতে প্রায় ২০-৩০ টাকা বেড়েছে সব ধরনের মাছের দাম। বর্তমানে কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি ফলি মাছ ৩০০ টাকা, পোয়া মাছ ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ ৭০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০-৬০০ টাকা, কোরাল মাছ ৬০০ টাকা, বাইলা মাছ ৪০০ টাকা, সুরমা মাছ ২০০ টাকা, কাঁচকি মাছ ৩০০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ৮০০ টাকা, চাপিলা মাছ ৪০০ টাকা, বোয়াল মাছ ৬০০ টাকা, সরপুঁটি ২৫০ টাকা, টেংরা ৮০০ টাকা, পুঁটি ২০০ টাকা, ইলিশ ৫০০-১৬০০ টাকা, শিং ৪০০ টাকা, কই ৬০০-৮০০ টাকা, শোল ৭০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ৭০০-১২০০ টাকা, বাগদা ৬০০ টাকা, হরিণা চিংড়ি ৫৫০ টাকা, কুঁচো চিংড়ি ৪০০ টাকা, রুই ৩২০ টাকা, কাতলা ৩৫০ টাকা, মাগুর ৮০০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

মাছ কিনতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা অনিক বলেন, মাছের দাম তো সব সময় বেশি। রমজানে নতুন করে আরেকটু বাড়লো। কিন্তু খেতে তো হবে। তাই বাড়তি দাম দিয়েই একটি কাতল মাছ কিনেছি।

সাজ্জাদ হোসেন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, মুরগির বাড়তি দামের কারণে মাছ কিনতে আসা। কিন্তু এখানেও কোনো কিছু ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। এত দাম হলে সাধারণ মানুষ খাবে কি?

মাছের দাম বেশি কেন- জানতে চাইলি বিক্রেতা চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, দেশি মাছের সরবরাহ কম। তাই দাম একটু বেশি। আর সবকিছুর দামই তো বেশি। আমরা কম দামে মাছ পামু কই?

এদিকে গরু ও খাসির মাংস আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ টাকা ও খাসি ১ হাজার ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৩
এসসি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।