ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

এবারও জোয়ারে ভাসার ভয়!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৫
এবারও জোয়ারে ভাসার ভয়! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে এসে: উপকূল জুড়ে এবারও জোয়ারে ভাসার ভয়। কোথাও বাঁধ নেই, কোথাও আবার নাজুক বাঁধ।

নড়বড়ে বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি ঢুকে প্রতিবছর বহু বাড়িঘর ডুবে, ফসলহানি ঘটে ব্যাপক। অনেক স্থানে ফসল পর্যন্ত করা সম্ভব হয় না। বিপন্ন মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। এবার বর্ষা মৌসুমেও এলাকার মানুষের একই আতঙ্ক।

উপকূল জুড়ে দুর্যোগের মৌসুম শুরু হয়েছে ১৫ মার্চ থেকে। ঝুঁকির এই মৌসুম চলবে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এরইমধ্যে কয়েকটি স্থানে পূর্নিমার জো-তে তলিয়েছে বাড়িঘর-ফসলি মাঠ।    

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা এলাকার অধিকাংশ স্থানে বেড়িবাঁধ অরক্ষিত রয়েছে। উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র  (সাইক্লোন সেন্টার) ঝ‍ূঁকিপূর্ণ। ফলে এবারের ঝড়ের মৌসুম সামনে রেখে এ এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে।

মহেশখালীর প্রান্তিক জনপদ মাতারবাড়ির রাজঘাট এলাকার এক কিলোমিটার, বিসিক এলাকার এক কিলোমিটার ও ধলঘাটার পশ্চিমের তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ একযুগ ধরে বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় বর্তমানে ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পশ্চিম পাশের বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যেকোনো মুহুর্তে পুরো বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে সাগরে তলিয়ে যাবার শঙ্কা রয়েছে। এলাকার ৮০ হাজার মানুষ হুমকির মুখে।

ধলঘাটার পশ্চিম অংশে এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এর কাজও শুরু হয়েছিল। এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে এলাকার মানুষের মনে জেগেছিল স্বপ্ন। কিন্তু হঠাৎ করেই বাঁধের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন মানুষের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্চু বলেন, এবার বর্ষার আগে বাঁধটি না হওয়ার কারণে গোটা ইউনিয়ন ঝুঁকিতে রয়েছে। শুধু ধলঘাটা নয়, পার্শবর্তী মাতারবাড়ী ইউনিয়নও সঙ্কটে পড়বে। দুর্ভোগ পোহাতে হবে অন্তত লক্ষাধিক মানুষকে। ইউনিয়নের অভ্যন্তরে যেসব রাস্তাঘাট করা হয়েছিল, সেগুলো এবারের বর্ষায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা ইউপি চেয়ারম্যানের।
   
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ধলঘাটা ও মাতারবাড়ীসহ মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে আবারো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ফলে বেড়িবাঁধের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। অথচ সংস্কার নেই দীর্ঘ এক যুগ ধরে। এই এলাকার বাসিন্দারা বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সূত্র বলছে, ১৭০০ শতাব্দীর শেষের দিকে সাগরের বুকে জেগে ওঠা ৩৬ বর্গমাইল আয়তনের দ্বীপ মহেশখালী প্রতিবছর সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে বিলীন হতে হতে ১৮ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। ষাটের দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকাকে লোনা জল ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় প্রায় ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে। বর্তমানে এই বাঁধের বেহাল দশা।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুল নাছের বলেন, উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ও সাইক্লোন শেলটার দ্রুত সংস্কারের ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে কাজ শুরু হবে।

মহেশখালীর পার্শ্ববর্তী আরেকটি দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার অবস্থাও নাজুক। কৈয়ারবিল, উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, বড়ঘোপ, আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা এবারও ঝুঁকিতে রয়েছে। গতবছর বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকার বহু মানুষ জোয়ারের পানিতে ভেসেছে। বিনষ্ট হয়েছে ফসল। জোয়ারের পানির তীব্রতায় গতবছর উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের চাষিরা কোন আবাদ করতে পারেননি। বেড়িবাঁধ সংস্কার ও মেরামতে এবার বর্ষার আগে এই উপজেলায় বিশেষ কোন কাজ হচ্ছেনা।

মধ্য উপকূলের ভোলার মনপুরা, চরফ্যাশন, পটুয়াখালীর কলাপাড়াসহ কয়েকটি স্থানে জোয়ারের পানির প্রবেশের ঝুঁকি থাকছে এবারও। বেড়িবাঁধহীন দ্বীপগুলো তো কোনভাবেই রক্ষা পাবে না। জোয়ার হলেই এসব এলাকা পুরোপুরি পানিতে ডুবে যায়। গতবছর মনপুরার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিপন্ন মানুষদের তিনবেলা রান্না করে খাওয়ার সুযোগও ছিল না।

রামনাবাদ নদীর তীরের বেড়িবাঁধ না থাকায় পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম গত বর্ষায় পানির নিচে তলিয়ে ছিল। এলাকা ছেড়ে বহু মানুষ বাইরে চলে যায়। সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার পর কয়েকবার এই বাঁধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বারবারই বাঁধ ভেঙে যায়। এবার বর্ষা মৌসুম শুরু ততে না হতেই ওই এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে।

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামার তারা জানান, চারিপাড়া ও পশুরবুনিয়া গ্রামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে গত বছর বর্ষা মৌসুমে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিলে কৃষকরা আউশ আবাদ করে গতবছরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সক্ষম হতো। এখন কৃষকদের জমি থাকলেও ফসল ফলানোর কোনো সুযোগ নেই।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, লালুয়ার পাঁচটি গ্রামের প্রায় অন্তত ১০০ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে গ্রামের ভেতর লোনা পানি প্রবেশ করায় গ্রামের সকল জমি আউশ আবদ করার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আব্দুর রহীম জানান, লোনা পানি গ্রামের ভেতর ঢুকে পরায় প্রখর রোদে পানি নষ্ট হয়ে ওই গ্রামগুলোর পরিবেশ কিছুটা দূষিত হতে পারে। এর প্রভাবে মানুষ ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত হতে পারে।

তবে চারিপাড়া ও পশুরবুনিয়া অংশের বেড়িবাঁধ সংস্কার বিষয় সঠিক তথ্য দিতে পারেননি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলাপাড়া উপ-বিভাগীয় প্রকৌলী মো. শহীদুল ইসলাম।     

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০২৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৫
/আরআইএম/কেএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।