ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

উপকূল থেকে উপকূল

স্কুলে যাওয়া নয়, কাঁকড়া ধরাই লাভজনক!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১৬
স্কুলে  যাওয়া নয়, কাঁকড়া ধরাই লাভজনক! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নিঝুপ দ্বীপ থেকে ফিরে: বিদ্যালয় ও শিক্ষক স্বল্পতা, অবহেলা, শিক্ষার সঠিক পরিবেশ না থাকা আর নগদ টাকার ‘লোভে’ শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে ঊপকূলের শিশুরা। দিনে মাত্র ৩০ টাকার বিনিময়ে তারা বিসর্জন দিচ্ছে নিজেদের কৈশোর আর শিক্ষাজীবন।

নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা ও বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার পরিবেশ সেখানে রসিকতা মাত্র। আর পরিবেশের এই দৈন্যতা হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্কুলে টানতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

বিচ্ছিন্ন চর নিঝুম দ্বীপে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যার মধ্যে তিনটি সরকারি।

স্থানীয়রা জানান, সরকারি স্কুলগুলো চলে মাত্র এক বা দুইজন শিক্ষক দিয়ে। তারাও ঠিকমতো আসেন না। আর এনজিও’র স্কুলগুলোতে যারা পড়ান, তাদেরও শিক্ষাগত যোগ্যতা সামান্যই।

আবার মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কাজ করে নগদ টাকা আয় করার নেশায় স্কুলমুখী হতে চায় না শিক্ষার্থীরাও। স্কুলের পরিবেশও তাদের টানে না।

নিঝুম দ্বীপ বিদ্যানিকেতনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রহমত রনি জানায়, সে স্কুলে গেলেও সেখানে তেমন একটা পড়ানো হয় না। স্যারেরা প্রতিদিন আসেনও না। এজন্য সময় নষ্ট না করে বন্ধুদের সঙ্গে সাগরে বা খালে কাঁকড়া ধরে সে।

একটা কাঁকড়া ধরতে পারলেই অন্তত ৩০ টাকা আয় হয়- পাশ থেকে বলে ওঠে রনিরই বন্ধু লিটন।

তাদের কাছে স্কুলে না গিয়ে কাঁকড়া ধরাই লাভজনক। যদিও কখনো কখনো কাঁকড়া ধরা পড়ে না। তখন কোন আয়ও হয় না। তবে সময় দিলে দিনে একটা কাঁকড়া ধরাই যায়। যার দাম অন্তত ৩০ টাকা। আর এই ৩০ টাকার জন্যই স্কুলকে এড়িয়ে যায় এসব শিশুরা।

চার সন্তানের অভিভাবক আনোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে না পেরে ‘গরু-মহিষ’ হয়ে যাচ্ছে’।

নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মেহরাজ বলেন, এলাকায় শিক্ষা নেই বললেই চলে। স্কুলে শিক্ষক আসেন না, ছেলে-মেয়েরাও স্কুলে যায় না। যে কয়েকটি এনজিও’র স্কুল আছে, সেখানেও অষ্টম শ্রেণি পাস শিক্ষক।    

শিশু লিটন বলে, ‘আমাদের স্কুলে শুধু মামুন স্যার আসেন, এরপর দক্ষিণ দিকে মুখ  করে বসে আমাদের বাতাস করতে বলেন। মাঝে মাঝে পড়তেও বলেন। কিন্তু আমরা পড়ি না। স্কুল থেকে চলে এসে কাঁকড়া, নইলে মাছ ধরি’।

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, স্কুলে চার-পাঁচজন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আসেন একজন। তার একটি দোকানও রয়েছে। স্কুলের তালা খুলে ছেলে-মেয়েদের পড়তে বলে তিনি দোকানে চলে যান। আর ছেলে-মেয়েরা যায় মাছ ধরতে। বছর গেলে ছাত্রদের ক্লাসে তুলে দেন, কিন্তু পড়ালেখা কি জিনিস- তা এরা শেখে না।

বঙ্গোপসাগরের বুকের এই চরের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই প্রাথমিক পর্যায় পার হয় না। আর অনেক কষ্টে যারা পার হয়, তাদের জন্য এখানে কোনো মাধ্যমিক স্কুল নেই। চরের একটি মাত্র নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে আটকে যায় তাদের শিক্ষাজীবন। পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে হলে নদী পার হয়ে প্রতিদিন জাহাজমারা  হাইস্কুলে আসতে হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে তা আর সম্ভব হয় না।  

হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাস বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার বিষয়ে অসচেতনতা রয়েছে। এছাড়া শিক্ষক সংকটও রয়েছে।

নিজ অফিসেও জনবল সংকটের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নয়জনের কাজ করছি তিনজনে। ফলে স্কুলগুলোতে বিশেষ করে চরাঞ্চলে নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না’।

‘তবে আমরা অল্প জনবল নিয়েও সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। যেসব স্কুলে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে, সেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় শিক্ষক পাঠাচ্ছি’।

হাতিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বাংলানিউজকে বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট বেশি নিঝুম দ্বীপে। এ বিষয়ে এখনই কোনো প্রতিশ্রুতি না দিতে পারলেও আশা করছি, দ্রুত সংকট কেটে যাবে’।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১৬
জেপি/এএসআর

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।