ঢাকা, সোমবার, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ শাবান ১৪৪৬

বইমেলা

মেলা শুধু বই কেনাবেচার নয়, সেবারও

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৬
মেলা শুধু বই কেনাবেচার নয়, সেবারও ছবি: দীপু মালাকার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বইমেলা থেকে: অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির প্রাণের, হৃদয়ের, বন্ধনের, চেতনার উৎসব। মাসব্যাপী এ মেলা শুধু বই কেনাবেচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর মাহাত্ম্য সার্বিক।

চেতনার এ বইমেলা সেবারও। বইয়ের নতুন গন্ধে মাতোয়ারা পাঠক-ক্রেতাদের বিভিন্ন সচেতনতার বার্তাও দিচ্ছে মেলা।

শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) মেলার ২৭তম দিন পুরো মেলা ঘুরে সে বার্তাই পাওয়া গেলো। এই যেমন রাজস্ব বোর্ডের আয়কর এবং কোম্পানি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলমের কথাই ধরা যাক। দাঁড়িয়ে থেকে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন তিনি। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বললেন, আয়কর বিষয়ে অনেকেই অবগত বা সচেতন নন, বিশেষ করে যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন। বড় এই জনসংখ্যার জন্য আমাদের সেবা- ‘আয়কর তথ্যকেন্দ্র’।

তবে এমন সেবা নিয়ে বইমেলায় কেন? উত্তরে জাহাঙ্গীর বলেন, বইমেলায় যারা আসেন তারা শিক্ষিত শ্রেণী। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে দেশ ও দশের উন্নতি। আয়করের অর্থে দেশের উন্নতি সাধিত হয়, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান নয়। মূলত দেশের জন্যই বইমেলায় আমাদের এ স্টল সাজানো।

undefined


এবার বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ের হওয়ার কথন শুনতে মেলার চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের স্টলে যাওয়া। সেখানে বিক্রয়কর্মী কামরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি সাফল্য, শিশুশিক্ষা বিষয়ে বইপত্রসহ শিশুতোষ ম্যাগাজিন আমরা কম দামে মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছি- যা কেউ করে না। এটি একটি বড় সেবা। এতো বড় বইমেলা হলেও শিশুর শিক্ষামূলক বইয়ের অভাব, কিন্তু তেমন বই আমাদের কাছে আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তার পাশেই। স্টলে বিক্রির দায়িত্বে থাকা আজহারুল ইসলাম জানালেন, গবেষণা বই তারা পাঠকের কাছে তুলে দিচ্ছেন। এছাড়া জানাচ্ছেন নিজেদের কার্যক্রম বিষয়ে। এতে মানুষ দেশের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে জ্ঞান পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগের স্টলে দেখা মেলে বিভিন্ন সেবার সংযুক্তি। ডাক যে এখন কেবল চিঠি আদান-প্রদানই নয়; সেটাই জানাচ্ছে স্টলটি। ডাক বিভাগ চালু করেছে পোস্ট ই-সেন্টারের কার্যক্রম- এতে মিলবে ডিজিটাল সব রকম সেবা। এবারের বইমেলার মাধ্যমে লাখো মানুষকে তারা নতুন করে এই পোস্ট-ই-সেবা বিষয়ে জানিয়েছেন- এমনই মত দিলেন স্টলের দায়িত্বে থাকা উত্তম কুমার চন্দ্র।

undefined


জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এমন সব বইয়ের পসরা সাজিয়েছে যেগুলো মেলার অন্য কোথাও নেই। অর্থাৎ যে প্রকাশনীগুলো স্টল বরাদ্দ পায়নি তাদের বই বিনা কমিশন গ্রহণে বিক্রি করে দিচ্ছে গ্রন্থকেন্দ্র। এতে অন্য লেখক-প্রকাশকরা উপকৃত হচ্ছেন। বিনিয়মে কোনো লভ্যাংশই রাখছে না জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। কেবলই সেবা এটি। তাদের সেবায় মেলা হয়ে উঠছে সার্বজনীন- বললেন স্টলের বিক্রয়কর্মী কে এম আনোয়ার। জানান, ১৭০ থেকে ১৮০টি বই তাদের বিক্রি তালিকায় আছে।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দিচ্ছে ধ্যানের মাধ্যমে কীভাবে নিজের এবং সমাজের উন্নতি সাধন করা যায় সে বিষয়ক ক্রোড়পত্র বা পুস্তিকা। যা মানুষের সানসিক সেবায় টনিক হিসেবে কাজ করবে। তার পাশে রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ‘বঙ্গবন্ধু বার্তা’। এখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছে, পাওয়া যাচ্ছে জাতির জনকের ছবির অ্যালবামও।

ধর্মীয় স্টলের মধ্যে রয়েছে সনাতন ধর্মের স্টল। সেখানে তারা ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন বইপত্র সরবরাহ করে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন, এমনটাই জানালেন বিক্রেতা সুন্দর কান্তি রৌ দাশ। তার পাশে আরেক ধর্মীয় স্টল- বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি। তারা বাইবেল সরবরাহ করছেন, সঙ্গে আছে ইনজিল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র মেলায় আগতদের দিচ্ছে আইনি সেবা। নারীদের যে কোনো অভিযোগ এবং বিভিন্ন সেবায় সংগঠনটি স্টল সাজিয়ে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তদন্ত অফিসার মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি বাংলানিউজকে বলেন, মানবাধিকার নিয়ে বই এবং এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছি আমরা। শুনছি অভিযোগও।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, দলীয় রাজনীতিমুক্ত ও অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মেলায় আছে তারাও। এখানে পাঠক-ক্রেতাদের দুর্নীতি বিষয়ে সচেতন করাই মূল কাজ টিআইবির।

প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র দিচ্ছে মেলায় যে কাউকে চিকিৎসা সেবা। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিন্তা নেই! আছে তাদের প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী।

undefined


বইমেলায় আরও আছে চ্যারিটি, যারা শিক্ষাবৃত্তি দেয়। রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনাও। তথ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য কমিশনও আলাদাভাবে রয়েছে; তারা বিভিন্ন দিক-সেবাও জানাচ্ছে। সদস্য হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলও বইমেলায় আছে। আরও আছে দেশের অন্যতম বড় শিল্পগ্রুপ বসুন্ধরা। তারা পেপার, খাতা মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে।

এছাড়াও বইমেলায় একদল স্বেচ্ছাসেবী (‘সুইচ’ সংগঠন)- বয়স্ক আর প্রতিবন্ধীদের হুইলচেয়ারে করে মেলা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। মেলার আরেক অংশ সোহরাওয়ার্দীতে রয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে রক্তদান কর্মসূচি। সেই সঙ্গে মেলার তথ্যকেন্দ্র (বর্ধমান ভবন) থেকে ২২ জনের একটি দল তো বইমেলা বিষয়ে টানা মৌখিক ও মাইকিং সেবা দিয়েই যাচ্ছেন।

এসব ছোট্ট-ছোট্ট সেবায় প্রাণের মেলায় প্রাণের ছোঁয়া আরও তরতাজাই কেবল হয়েছে সারাটি মাস। আর দু’টি দিন বাদে বিদায়ের পরেও মেলার এমন স্মৃতি পাঠককে জোগাবে ১১ মাসের রসদ।

শনিবারের (২৭ ফেব্রুয়ারি) মেলা
শনিবার মেলার শেষ ছুটির দিন সকালে বাংলা একাডেমি ঘোষিত শিশুপ্রহর না হলেও কচিকাঁচার আসর জমেছিল যেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মেলার সকাল থেকে দুপুরটা ছিল এক প্রকার শিশুদের রাজ্য। বাবা মায়ের হাত ধরে শিশুদের পদচারণায় মুখরিত ছিল মেলা। হালুম, টুকটুকি, ইকরি চরিত্রগুলো শিশুদের কাছে আসে এবং সচেতনতা বাণী শোনায়। সঙ্গে নাচে, গানে আর কথায় মাতিয়ে রাখে।

undefined


দুপুরের পর থেকে অর্থাৎ বিকেলে মেলা চলে যায় তরুণ-তরুণীদের দখলে। ছিল পারিবারিকভাবে মেলায় আগতদের সংখ্যাও। যারাই আসেন এদিন, অন্তত একটি বই তারা কিনেছেন।

মেলায় এখন বিদায় বিরহের সুর। কেমন গেলো এবারের বইমেলা, জানতে চাইলে তাম্রলিপি প্রকাশনীর এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি বাংলানিউজকে বলেন, মেলা এবার দারুণ জমেছে। শুক্র ও শনিবার বিক্রির হার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এখন যারাই দর্শনার্থী তারাই ক্রেতা। আশা শেষ দু’দিন রোববার ও সোমবারও খারাপ বেচাকেনা হবে না।

পুরস্কার ঘোষণা
এদিকে বিকেলে গ্রন্থমেলা-২০১৬ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। চার ক্যাটাগরির এ পুরস্কারের তালিকা শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঘোষণা করা হয়। এবার পুরস্কার পেয়েছে আটটি প্রকাশনা সংস্থা। সোমবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

তারপর সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার-২০১৬ ঘোষণা করা হয়। ভূষিত হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ সাত নবীন-প্রবীণ লেখক। দুই ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। যার পুরস্কার দেওয়া হবে মার্চের প্রথম সপ্তাহে।

নতুন বই সংখ্যা
মেলার শেষ সময়ে এসেও ১৭৯টি বই এসেছে এদিন, জানিয়েছে আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমি। যার মধ্যে কবিতা সবচেয়ে বেশি ৬০টি, গল্প ৩২, উপন্যাস ১৫, প্রবন্ধ ১৪, শিশুতোষ ১০, ছড়া ০৭ এবং বাকিগুলো অন্যান্য।

undefined


বইমেলার মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ৬ দফার পঞ্চাশ বছর শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এবং কলামিস্ট সুভাষ সিংহ রায়। সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনন্ত হীরা’র পরিচালনায় নাটক ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ পরিবেশন করে নাট্য সংগঠন ‘প্রাঙ্গণে মোর’।

রোববারের (২৮ ফেব্রুয়ারি) আয়োজন
এদিন নতুন সময়ে মেলা শুরু হবে দুপুর ২টায় এবং শেষ হবে রাত ৮টায়। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মোস্তফা জব্বার। আলোচনায় অংশ নেবেন সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার এবং লেখক প্রকাশক তারিক সুজাত।

সভাপতিত্ব করবেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৬
আইএ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।